পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আলেয়া-উচ্ছ্বাসে নিজেদের বিশ্বায়িত করার জন্যে হঠাৎ উৎকট আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছি আমরা।

 উত্তর-আধুনিকতার বীজতলিকে খুঁজতে হয় না, উপভাষার সহগামী লঘুসংস্কৃতির মধ্যে তা স্বাভাবিকভাবে উপস্থিত। কেন্দ্রীয় এলাকার তুলনায় আমাদের অপর পরিসর বিকেন্দ্রায়নের শতজল ঝরনায় উচ্ছ্বসিত হতে পারে। অথচ আজ কোনো ভগীরথ সেই ঝর্নার ধ্বনিকে জটাজাল ভেদ করে আমাদের উৎসুক ইন্দ্রিয়ের কাছে নিয়ে এল না। আমাদের আপাত-বিচ্ছিন্নতা মূল সংস্কৃতির সমস্ত বেগবান ধারাকে সমান মাপে প্রাসঙ্গিক করে তোলেনি। দ্বীপবাসী যেভাবে ঊর্মিমালার দিকে তাকায়, আমরাও সেভাবে সময়ের ক্রুর উদাসীন উচ্ছ্বাসের পানে তাকিয়েছি। আমাদের ওই তাকানোয় অভ্যাস ছিল, দেখার আশ্চর্য ছিল না। চিরকাল যারা স্রোতের উপান্তে থাকে কিংবা নিবদ্ধ থাকে বেলাভূমিতে, সমগ্র বহমানতা সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণা তৈরি হয়। অথবা সমগ্রের পরিধিতে আদৌ কোনও অবস্থান উপ-সংস্কৃতির দ্যোতনাসম্পন্ন প্রত্যাখ্যাত ও দূরীকৃত অপর পরিসরের পক্ষে সম্ভব কিনা—এই প্রশ্নের মীমাংসা নিয়েও মাথা ঘামায় না কেউ।

 বীরভূম বা মালদহের আঞ্চলিক উপভাষায় যেসব বাঙালিরা কথা বলেন, তাদের কিন্তু বাঙালিত্ব প্রমাণ করতে হয় না। চট্টগ্রাম-নোয়াখালির উপভাষার প্রকট স্বাতন্ত্র সত্ত্বেও জাতিসত্তা নিয়ে অনাবশ্যক জটিলতা দেখা যায় না। কিন্তু ঔপনিবেশিক প্রভুশক্তির সাংস্কৃতিক রাজনীতির শিকার হওয়ার ফলে বারবার সিলেটি উপভাষী মানুষের উপর নেমে এসেছে বানিয়ে-তোলা অস্তিত্বের সংকট। বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসন দিয়ে আসামের সঙ্গে সিলেটকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আসামের আধিপত্যবাদীরা প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি লুব্ধতা ছাড়তে পারেনি, কিন্তু মেধার উৎকর্ষ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকেও মেনে নিতে চায়নি। সিলেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত অবিভক্ত কাছাড়ও একই কারণে আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদীদের কাছে চক্ষুশূল। বাংলার সংস্কৃতিবিশ্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এই অঞ্চলের মানুষজন যাতে শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে মর্যাদা দাবি করতে না পারে, এজন্যে ধূর্ত চক্রান্তের জাল বিছানো হয়েছে সর্বত্র। এর সর্বশেষ উৎকট নিদর্শন হল, কিছু বেতনভুক উচ্ছিষ্টজীবী দালালদের দিয়ে বাঙালিদের উদ্দেশ্য আহ্বান জানানো—তারা যেন আগামী লোকগণনায় অসমিয়াকে নিজেদের মাতৃভাষা বলে ঘোষণা করে।

 গোটা আসাম জুড়ে বাঙালিরা প্রধানত কোনও না কোনও উপভাষায় কথা বলেন। এতে মূখদের পোয়াবারো, কারণ, অসমিয়ার অপভ্রংশ বলে সমস্ত অপর পরিসর এবং তাদের স্থানিক সংস্কৃতিকে গ্রাস করার অজুহাত বানানো যায়। সমস্ত বাংলা মাধ্যমের স্কুলকে কবেই মুছে ফেলা হয়েছে; নয়া অসমিয়া নামক কাঠালের আমসত্ত্বও তৈরি করা হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি থেকে বহুদূরে থাকার ফলে এবং সাম্প্রতিক গৈরিকীকরণের পর্যায়ে হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার পরিণতিতে দূরবর্তী অপরেরা নিজেদের গোত্রপরিচয় ভুলে যেতে বসেছে। বিনিময়ে পাচ্ছে

৯১