পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হইবে There is neither Greek nor jew but Christ is all অর্থাৎ খ্রিস্টভক্তের গ্রীক বা যীহুদী নাই সব খ্রিস্টান। বঙ্গভাষারও শ্রীহট্টনদীয়া নাই, অখণ্ড বঙ্গভূমি জুড়িয়া সব বাঙ্গালা’।

 ভাবতে অবাক লাগে, ৯৩ বছর আগে এই কথাগুলি উচ্চারিত হয়েছিল। ভুবনমোহনের অভিভাষণ আজকের আত্মবিস্মৃত বরাকবাসী বাঙালি বারবার পুনঃপাঠ করুন। বিশেষত নিম্নরেখাঙ্কিত বাক্যগুলি মন্ত্রের মতো পুনরুচ্চারণ করুন। তাহলে এই সত্য স্পষ্ট হবে যে, ভুবনমোহনের সময়ে যেমন আমাদের ভাষা ও সাহিত্য লইয়া’..সন্দেহবাত্যা বয়ে গিয়েছিল, সেই ‘সন্দেহবাত্যা’ সাংস্কৃতিক রাজনীতির আয়ুধ হিসেবে কয়েক বছর পরপর ব্যবহৃত হচ্ছে। অবিভক্ত কাছাড়কে অসমিয়াভূত গোয়ালপাড়া বানানোর চক্রান্ত, ৬০ সালের বঙ্গালখেদা, ৭২ এবং ৮৬ সালে আঞ্চলিক উপনিবেশবাদীদের চোয়া ভেঁকুর, ৭৮-৭৯ থেকে ৮৫-৮৬ পর্যন্ত বহিরাগত তাড়ানোর উগ্রতা এবং সম্প্রতি আসামবাসী বাঙালিকে অসমিয়া করে নেওয়ার উদ্ভট পরিকল্পনা—সমস্ত ক্ষেত্রে ভুবনমোহনের ‘সন্দেহবাত্যা’ কখনও ঘুর্ণিবায়ু, কখনও দাবানল, কখনও অগ্ন্যুৎপাত হয়ে দেখা দিয়েছে। ভুবনমোহনকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির মোকাবিলা করতে হয়েছিল ৯৩ বছর আগে, আমাদেরও করতে হচ্ছে।

 কয়েক বছর আগে পাঠ্যপুস্তক এবং খবরের কাগজের ভাষায় বিদূষণ ঘটানোর দুরভিষন্ধিমূলক পরিকল্পনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ‘সাহিত্য’-এর সম্পাদক কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য। এই বিদূষণ এখন আরও কালান্তক মূর্তি নিয়ে হাজির হয়েছে। এর মোকাবিলা করতে হবে সুদৃঢ় ভাবাদর্শগত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। ভুবনমোহনের প্রবন্ধ আমাদের আয়ুধ হোক। বিশেষত নিম্নরেখাঙ্কিত অংশ হোক আমাদের জপমন্ত্র। বরাক উপত্যকার উপভাষাভাষী কবি-লিখিয়েরা জেলায় জেলায় স্বতন্ত্র সাহিত্যভাণ্ডার’ এর মূখ ধারণাকে ভুবনমোহনের মতোই প্রত্যাখ্যান করুন। বিহারের সিংভূম অঞ্চলে কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর অঞ্চলের জীবনযাপন ও বাগবৈভব ব্যবহার করেন বলে কি গল্পকার অনিল ঘড়াই, স্বপ্নময় চক্রবর্তীকে অথবা বাঁকুড়া-বীরভূমের ছাপ আছে বলে কথাসাহিত্যিক ভগীরথ মিশ্র-সৈকত রক্ষিত এবং কবি নির্মল হালদারকে অথবা উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক জীবনের রূপকার অভিজিৎ সেনকে আমরা নিছক স্থানীয়’ লেখক বলি? বাস্তব অলঙ্, উপভাষার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সেই বাস্তবের সূক্ষ্ম অভিজ্ঞতা ও ইশারা খচিত হয়ে থকে। সমস্ত কিছুকে আত্তীকৃত করেই গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষার সাহিত্য-ভুবন।

 আজ কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী-শঙ্করজ্যোতি দেব-বিজয়কুমার ভট্টাচার্য-স্বর্ণালী বিশ্বাস কিংবা গল্পকার শেখর দাশ-মিথিলেশ ভট্টাচার্য-বদরুজ্জামান চৌধুরী-সুব্রতকুমার রায়-রণবীর পুরকায়স্থ কিংবা প্রাবন্ধিক সুজিৎ চৌধুরী কি নিছক বরাকের লেখক হিসেবে পরিচিত? দেবীপ্রসাদ সিংহ গৌহাটিতে, দুলাল ঘোষ আগরতলায়, সাধন চট্টোপাধ্যায় কলকাতার মফঃস্বলে, দেবেশ রায় কলকাতায়, সেলিনা হোসেন ঢাকায়, হাসান আজিজুল হক রাজশাহীতে, উদয়ন ঘোষ আসানসোলে, কমল চক্রবর্তী

৯৪