বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:সমাজ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯৬
সমাজ

 বৃহৎ ভাবের নিকটে আত্মবিসর্জ্জন করাকে যদি পাগ‍্লামি বলে, তবে সেই পাগলামি এককালে প্রচুর পরিমাণে আমাদের ছিল। ইহাই প্রকৃত বীরত্ব। কর্ত্তব্যের অনুরোধে রাম যে রাজ্য ছাড়িয়া বনে গেলেন তাহাই বীরত্ব, এবং সীতা ও লক্ষ্মণ যে তাঁদের অনুসরণ করিলেন, তাহাও বীরত্ব। ভরত যে রামকে ফিরাইয়া আনিতে গেলেন, তাহা বীরত্ব, এবং হনুমান যে প্রাণপণে রামের সেবা করিয়াছিলেন, তাহাও বীরত্ব। হিংসা অপেক্ষা ক্ষমায় যে অধিক বীরত্ব, গ্রহণের অপেক্ষা ত্যাগে অধিক বীরত্ব, এই কথাই আমাদের কাব্যে ও শাস্ত্রে বলিতেছে। পালোয়ানীকে আমাদের দেশে সর্ব্বাপেক্ষা বড় জ্ঞান করিত না। এই জন্য বাল্মীকির রাম রাবণকে পরাজিত করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, রাবণকে ক্ষমা করিয়াছেন। রাম রাবণকে দুইবার জয় করিয়াছেন। একবার বাণ মারিয়া, একবার ক্ষমা করিয়া। কবি বলেন, তন্মধ্যে শেষের জয়ই শ্রেষ্ঠ। হোমরের একিলিস পরাভূত হেক্টরের মৃতদেহ ঘোড়ার লেজে বাঁধিয়া সহর প্রদক্ষিণ করিয়াছিলেন, রামে একিলিসে তুলনা কর। য়ুরোপীয় মহাকবি হইলে পাণ্ডবদের যুদ্ধ জয়েই মহাভারত শেষ করিতেন, কিন্তু আমাদের ব্যাস বলিলেন, রাজ্য গ্রহণ করায় শেষ নহে রাজ্য ত্যাগ করায় শেষ। যেখানে সব শেষ তাহাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। কেবল তাহাই নহে আমাদের কবিরা পুরস্কারেরও লোভ দেখান নাই। ইংরাজেরা Utilitarian, কতকটা দোকানদার, তাই তাঁহাদের শাস্ত্রে Poetical Justice নামক একটা শব্দ আছে, তাহার অর্থ দেনা পাওনা, সৎ কাজের দরদাম করা। আমাদের সীতা চিরদুঃখিনী—রাম লক্ষ্মণের জীবন দুঃখে কষ্টে শেষ হইল। এত বড় অর্জ্জুনের বীরত্ব কোথায় গেল, অবশেষে দস্যুদল আসিয়া তাঁহার নিকট হইতে যাদব রমণীদের কাড়িয়া লইয়া গেল, তিনি গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না। পঞ্চপাণ্ডবের সমস্ত জীবন দারিদ্র্যে দুঃখে শোকে