পাতা:সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
সাহিত্যের সামগ্রী
১৯

কীর্তি কোন্‌টা? জল মানুষের সৃষ্টি নহে, তাহা চিরন্তন। সেই জলকে বিশেষভাবে সর্বসাধারণের ভোগের জন্য সুদীর্ঘকাল রক্ষা করিবার যে উপায় তাহাই কীর্তিমান মানুষের নিজের। ভাব সেইরূপ মনুষ্য-সাধারণের, কিন্তু তাহাকে বিশেষ মূর্তিতে সর্বলোকের বিশেষ আনন্দের সামগ্রী করিয়া তুলিবার উপায়রচনাই লেখকের কীর্তি।

 অতএব দেখিতেছি, ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা। অঙ্গার-জিনিসটা জলে স্থলে বাতাসে নানা পদার্থে সাধারণভাবে সাধারণের আছে; গাছপালা তাহাকে নিগূঢ় শক্তিবলে বিশেষ আকারে প্রথমত নিজের করিয়া লয়, এবং সেই উপায়েই তাহা সুদীর্ঘকাল বিশেষভাবে সর্বসাধারণের ভোগের দ্রব্য হইয়া উঠে। শুধু যে তাহা আহার এবং উত্তাপের কাজে লাগে তাহা নহে; তাহা হইতে সৌন্দর্য, ছায়া, স্বাস্থ্য বিকীর্ণ হইতে থাকে।

 অতএব দেখা যাইতেছে, সাধারণের জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করিয়া, সেই উপায়েই তাহাকে পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারণের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।

 তা যদি হয়, তবে জ্ঞানের জিনিস সাহিত্য হইতে আপনি বাদ পড়িয়া যায়। কারণ, ইংরেজিতে যাহাকে ট্রুথ বলে এবং বাংলাতে যাহাকে আমরা সত্য নাম দিয়াছি, অর্থাৎ যাহা আমাদের বুদ্ধির অধিগম্য বিষয়, তাহাকে ব্যক্তিবিশেষের নিজত্ববর্জিত করিয়া তোলাই একান্ত দরকার। সত্য সর্বাংশেই ব্যক্তিনিরপেক্ষ, শুভ্রনিরঞ্জন। মাধ্যাকর্ষণতত্ত্বআমার কাছে একরূপ, অন্যের কাছে অন্যরূপ নহে। তাহার উপরে বিচিত্র হৃদয়ের নূতন নূতন রঙের ছায়া পড়িবার জো নাই।

 যে-সকল জিনিস অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হইবার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর রঙ ইঙ্গিত প্রার্থনা করে, যাহা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্ট না হইয়া উঠিলে অন্য হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠালাভ করিতে পারে না,