পাতা:সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
২৫৮
সাহিত্য

তাঁহার রাজদণ্ডের সমস্ত বিভীষিকা উদ্যত করিয়াও ইহা পারেন না। শতবৎসর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ যে গান গাহিয়া গিয়াছেন শতবৎসর পরেও সেই গান বাঙালির কণ্ঠ হইতে উৎপাটিত করিতে পারে এত বড়ো তরবারি কোনো রাজাস্ত্রশালায় আজও শানিত হয় নাই। একি সামান্য শক্তি আমাদের প্রত্যেক বাঙালির হাতে আছে! এ শক্তি ভিক্ষালব্ধ নহে। ভূমিষ্ঠ হইবার পরক্ষণ হইতেই জননীর সুধাকণ্ঠ হইতে স্নেহবিগলিত এই শক্তি আমরা আনন্দের সহিত সমস্ত মন প্রাণ দিয়া আকর্ষণ করিয়া লইয়াছি এবং এই চিরন্তন শক্তিযোগে সমস্ত দুরত্ব লঙ্ঘন করিয়া, অপরিচয়ের সমস্ত বাধা ভেদ করিয়া, আজ এই সভাতলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের, উপস্থিত ও অনাগতের, সমস্ত বাঙালিকে আপন উদ্‌বেল হৃদয়ের সম্ভাষণ জানাইবার অধিকারী হইয়াছি।

 বাঙালির সঙ্গে বাঙালিকে গাঁথিবার জন্য কত কাল ধরিয়া বঙ্গসাহিত্য হৃদয়তন্তুনির্মিত নানা রঙের একটা বিপুল মিলনজাল রচনা করিয়া আসিয়াছে। আজ তাহা আমাদের এতে বেশি অঙ্গীভূত হইয়া গেছে যে, তাহা আমাদের শিরা পেশী প্রভৃতির মতো আমাদের চোখেই পড়িতে চায় না। এ দিকে রাজকীয় মন্ত্রণাসভায় দুই-একজন দেশীয় মন্ত্রী -নিয়োগ বা পৌরসভায় দুই-চরি জন দেশীয় প্রতিনিধি -নির্বাচনের শূন্যগর্ভ বিড়ম্বনাকেই আমরা পরম সৌভাগ্য বলিয়া গণ্য করি। ঔষধ যতই কটু হয় তাহাকে ততই হিতকর বলিয়া ভ্রম হয়; যে চেষ্টায় যত বেশি ব্যর্থ কষ্ট তাহার ফলটুকুকে ততই অধিক বলিয়া আমরা মনে করি। কারণ, ভাঙা পথে তৈলহীন গোরুর গাড়ির চাকার মতো পণ্ডশ্রমই সব চেয়ে বেশি শব্দ করিতে থাকে—তাহার অস্তিত্ব এক মুহূর্ত ভুলিয়া থাকা কঠিন।

 কিন্তু কাজের সময় হঠাৎ দেখিতে পাই যাহা সত্য, যাহা কষ্টকল্পনা নহে, তাহার শক্তি অধিক, অথচ তাহা নিতান্ত সহজ। আমরা বিদেশী ভাষায় পরের দরবারে এত কাল যে ভিক্ষা কুড়াইলাম তাহাতে লাভের