পাতা:সাহিত্য-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৬৬
সাহিত্য

ভুলাইবার জন্যই, আর তো কোনো কারণ দেখি না। হৃদয়ই জানে, জগতের মধ্যে একটি হৃদয় কেবলই আপনাকে প্রকাশ করিতেছে। নহিলে সৃষ্টির মধ্যে এত রূপ, এত গান, এত হাবভাব, এত আভাস-ইঙ্গিত, এত সাজসজ্জা কেন? হৃদয় যে ব্যাবসাদারির কৃপণতায় ভোলে না, সেইজন্যই তাহাকে ভুলাইতে জলে স্থলে আকাশে পদে পদে প্রয়োজনকে গোপন করিয়া এত অনাবশ্যক আয়োজন। জগৎ যদি রসময় না হইত তবে আমরা নিতান্তই ছোটো হইয়া অপমানিত হইয়া থাকিতাম; আমাদের হৃদয় কেবলই বলিত, জগতের যজ্ঞে আমারই নিমন্ত্রণ নাই। কিন্তু সমস্ত জগৎ তাহার অসংখ্য কাজের মধ্যেও রসে ভরিয়া উঠিয়া হৃদয়কে এই মধুর কথাটি বলিতেছে যে, আমি তোমাকে চাই: নানারকম করিয়া চাই; হাসিতে চাই, কান্নাতে চাই; ভয়ে চাই, ভরসায় চাই; ক্ষোভে চাই, শান্তিতে চাই।

 এমনি জগতের মধ্যেও আমরা দুটা ব্যাপার দেখিতেছি, একটা কাজের প্রকাশ, একটা ভাবের প্রকাশ। কিন্তু, কাজের ভিতর দিয়া যাহা প্রকাশ হইতেছে তাহাকে সমগ্ররূপে দেখা ও বোঝা আমাদের কর্ম নয়। ইহার মধ্যে যে অমেয় জ্ঞানশক্তি আছে আমাদের জ্ঞান দিয়া তাহার কিনারা পাওয়া যায় না।

 কিন্তু ভাবের প্রকাশ একেবারে প্রত্যক্ষ প্রকাশ। সুন্দর যাহা তাহা সুন্দর। বিরাট যাহা তাহা মহান। রুদ্র যাহা তাহা ভয়ংকর। জগতের যাহা রস তাহা একেবারে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে এবং আমাদের হৃদয়ের রসকে বাহিরে টানিয়া আনিতেছে। এই মিলনের মধ্যে লুকোচুরি যতই থাক্‌, বাধাবিঘ্ন যতই ঘটুক, তবু প্রকাশ ছাড়া এবং মিলন ছাড়া ইহার মধ্যে আর-কিছুই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

 তবেই দেখিতেছি, জগৎসংসারে ও মানবসংসারে একটা সাদৃশ্য আছে। ঈশ্বরের সত্যরূপ জ্ঞানরূপ জগতের নানা কাজে প্রকাশ পাইতেছে, আর তাঁহার আনন্দরূপ জগতের নানা রসে প্রত্যক্ষ হইতেছে। কাজের মধ্যে