পাতা:সীতারাম- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sog সীতারাম কন্যাকে মনে করিয়া, আমাকে সেই কন্যা ভাবিয়া চক্ষু আবৃত করুক। যে হিন্দু, যাহার দেবত ব্রাহ্মণে ভক্তি আছে, সেই চকু আবৃত করুক। যাহার মাতা অসতী, যে বেতার গর্ভে জন্মিয়াছে, সে যাহা ইচ্ছা করুক, তাহার কাছে আমার লজ্জা নাই, আমি তাহাদের মনুষ্যের মধ্যে গণ্য করি না ।” লোকে এই কথা শুনিয়া চক্ষু বুজিল, কি না বুজিল, জয়ন্তী তাহ আর চাহিয়া দেখিল না । মন তখন খুব উচু সুরে বাধা আছে—জয়ন্তী তখন জগদীশ্বর ভিন্ন আর কাহাকে দেখিতে পাইতেছে না। জয়ন্তী কেবল রাজার দিকে ফিরিয়া বলিল, “তোমার আজ্ঞায় । আমি বিবস্ত্ৰ হইব। কিন্তু তুমি চাহিয়া দেখিও না। তুমি রাজ্যেশ্বর ; তোমায় পশুবৃত্ত দেখিলে প্রজারা কি না করিবে ? মহারাজ, আমি বনবাসিনী, বনে থাকিতে গেলে অনেক সময়ে বিবস্ত্র হইতে হয়। একদা আমি বাঘের মুখে পড়িয়াছিলাম—বাঘের মুখ হইতে আপনার শরীর রক্ষা করিতে পারিয়াছিলাম, কিন্তু বস্ত্র রক্ষা করিতে পারি নাই। তোমাকেও আমি, তোমার আচরণ দেখিয়া সেইরূপ বন্য পশু মনে করিতেছি, অতএব তোমার কাছে আমার লজ্জা হইতেছে না। কিন্তু তোমার লজ্জা হওয়া উচিত—কেন না, তুমি রাজা এবং গৃহী, তোমার মহিষী আছেন। চক্ষু বুজ ।” বৃথা বলা ! তখন মহাক্রোধান্ধকারে রাজা একেবারে অন্ধ হইয়াছেন। জয়ন্তীর কথার কোন উত্তর না দিয়া, কসাইকে বলিলেন, “জবরদস্তী কাপ্‌ড়া উতার লেও।” তখন জয়ন্তী আর বৃথা কথা না কহিয়া, জামু পাতিয়া মঞ্চের উপর বসিল। জয়ন্তী আপনার কাছে আপনি ঠকিয়াছে,—এখন বুঝি জয়ন্তীর চোখে জল আসে। জয়ন্তী মনে করিয়াছিল, “যখন পৃথিবীর সকল সুখদুঃখে জলাঞ্জলি দিয়াছি, যখন আর আমার মুখঞ্জ নাই, দুঃখও নাই, তখন আমার আবার লজ্জা কি ? ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আমার মনের যখন কোন সম্বন্ধ নাই, তখন আমার আর বিরস্ত্র আর সৰস্ত্র কি ? পাপই লজ্জা, আবার কিসে' লজ্জা করিব ? জগদীশ্বরের নিকট ভিন্ন, সুখদুঃখের অধীন মনুষ্যের কাছে লজ্জা কি ? আমি কেন এই সভামধ্যে বিবস্ত্র হইতে পারিব না ?” তাই জয়ন্তী এতক্ষণ আপনাকে বিপন্নই মনে করে নাই—বেত্ৰাঘাতটা ত গণ্যের মধ্যে নহে। কিন্তু এখন যখন বিবস্ত্র হইবার সময় উপস্থিত হইল—তখন কোথা হইতে পাপ লজ্জা আসিয়া সেই ইন্দ্রিয়বিজয়িনী সুখদুঃখবর্জিত জয়ন্তীকেও অভিভূত করিল। তাই নারীজন্মকে ধিকার দিয়া জয়ন্তী মঞ্চতলে জামু পাতিয়া বসিল। তখন যুক্তকরে, পবিত্রচিত্তে জয়ন্তী আত্মাকে সমাহিত করিয়া মনে মনে ডাকিতে লাগিল, “দীনবন্ধু ! আজ রক্ষা কর! মনে করিয়াছিলাম, বুঝি এ পৃথিবীর