পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিয়া রহিল। আবার জিজ্ঞাসা হইল। “কে কে চেঁচাইয়াছিলে?” পাঁচ-সাতটি ছেলে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, “শ্যামলাল।” শ্যামলাল যে একা অত মারাত্মক রকম চেঁচাইতে পারে এ কথা কেহই বিশ্বাস করিল না—সুতরাং স্কুলসুদ্ধ ছেলেকে সেদিন স্কুলের পর আটকাইয়া রাখা হইল।

 অনেক তম্বিতাম্বার পর একে একে সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িল। তখন হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কবিতা লেখার রোগ হয়েছে? ও রোগের ওষুধ কি?” বৃদ্ধ পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “বিষস্য বিষমৌষধম্‌—বিষের ওষুধ বিষ। বসন্তের ওষধ যেমন বসন্তের টিকা, কবিতার ওষুধ তস্য টিকা। তোমরা যে যা কবিতা লিখেছ তার টিকা করে দিচ্ছি। তোমরা একমাস প্রতিদিন পঞ্চাশ বার করে এটা লিখে এনে রোজ আমায় দেখাবে।” এই বলে তিনি টিকা দিলেন—

পদে পদে মিল খুঁজি, গুনে দেখি চোদ্দো
মনে করি লিখিতেছি ভয়ানক পদ্য।
হয় হব ভবভূতি নয় কালিদাস
কবিতার ঘাস খেয়ে চরি বারোমাস।

 একমাস তিনি আমাদের কাছে এই লেখা প্রতিদিন পঞ্চাশবার আদায় না করিয়া ছাড়িলেন না। এ কবিতার কি আশ্চর্য গুণ তার পর হইতে কবিতা লেখার ফ্যাশান স্কুল হইতে একেবারেই উঠিয়া গেল।

সন্দেশ—জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৩


নূতন পণ্ডিত

 আগে যিনি আমাদের পণ্ডিত ছিলেন, তিনি লোক বড়ো ভালো। মাঝে মাঝে আমাদের যে ধমক-ধামক না করিতেন, তাহা নয়—কিন্তু কখনো কাহাকেও অন্যায় শাস্তি দেন নাই। এমন-কি, ক্লাশে আমরা কত সময় গোল করিতাম; তিনি কেবল মাঝে মাঝে ‘আঃ’ বলিয়া ধমক দিতেন। তাঁহার হাতে একটা ছড়ি থাকিত। খুব বেশি রাগ করিলে সেই ছড়িটাকে টেবিলের উপর আছড়াইতেন—সেটাকে কোনোদিন কাহারো পিঠে পড়িতে দেখি নাই। তাই আমরা কেউ তাঁহাকে মানিতাম না।

 আমাদের হেডমাস্টার মশাইটি দেখিতে তাঁর চাইতেও নিরীহ ভালোমানুষ। ছোট্টো বেঁটে মানুষটি, গোঁফদাড়ি কামান গোলগাল মুখ। তাহাতে সর্বদাই যেন হাসি লাগিয়াই আছে। কিন্তু চেহারায় কি হয়? তিনি যদি “শ্যামাচরণ কার নাম?” বলিয়া ক্লাশে আসিয়া আমায় ডাক দিতেন, তবে তাঁহার গলার আওয়াজেই আমার হাত-পা যেন পেটের মধ্যে ঢুকিয়া যাইত। তাঁহার হাতে কোনোদিন বেত দেখি নাই। কারণ বেতের কোনো দরকার হইত না—তাঁহার হুংকারটি যার উপর পড়িত সেই চক্ষে অন্ধকার দেখিত।

১০২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী:২