পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 একদিন পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “সোমবার থেকে আমি আর পড়াতে আসব না— কিছুদিনের ছুটি নিয়েছি। আমার জায়গায় আর-একজন আসবেন। দেখিস তার ক্লাশে তোরা যেন গোল করিস নে।” শুনিয়া আমাদের ভারি উৎসাহ লাগিল। তার পর যে কয়দিন পণ্ডিতমহাশয় স্কুলে ছিলেন, আমরা ক্লাশে এক মিনিটও পড়ি নাই। একদিন বেহারীলাল পড়ার সময় পড়িয়াছিল, সেইজন্য আমরা পরে চাঁদা করিয়া তাহার কান মলিয়া দিয়াছিলাম। যাহা হউক পণ্ডিতমহাশয় সোমবার আর আসিলেন না-তাহার বদলে যিনি আসিলেন তাঁহার গোল কালো চশমা, মুখভরা গোঁফের জংগল আর বাঘের মতো আওয়াজ শুনিয়া আমাদের উৎসাহ দমিয়া গেল। তিনি ক্লাশে আসিয়াই বলিলেন, “পড়ার সময়ে কথা বলবে না, হাসবে না, যা বলব তাই করবে-রোজকার পড়া রোজ করবে। আর যদি তা না কর, তা হলে তুলে আছাড় দেব।” শুনিয়া আমাদের তো চক্ষুস্থির।

 ফকিরচাঁদের, তখন অসুখ ছিল, সে বেচারা কদিন পরে ক্লাশে আসিতেই নুতন পণ্ডিতমহাশয় তাহাকে পড়া জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন। ফকির থতমত খাইয়া ভয়ে অমিতা-আমতা করিয়া বলিল “আজ্ঞে - আমি ইস্কলে আসি নি-” পণ্ডিতমহাশয় রাগিয়া বলিলেন, “ইস্কুলে আসি নি তো কোথায় এসেছ? তোমার মামারবাড়ি?” ফকির বেচারা কাঁদকাঁদ হইয়া বলিল, “সাতদিন স্কুলে আসি নি—কি করে পড়া বলব?” পণ্ডিতমহাশয়, “চোপরাও বেয়াদব-মুখের উপর মুখ” বলিয়া এমন ভয়ানক গর্জন করিয়া উঠিলেন, যে ভয়ে ক্লাশসুদ্ধ ছেলের মুখের তালু শুকাইয়া গেল।

 আমাদের হরিপ্রসন্ন অতি ভালো ছেলে। সে একদিন স্কুলের অফিসে গিয়া খবর পাইল—সে নাকি এবার কী একটা প্রাইজ’ পাইবে-খবরটা শুনিয়া বেচারা ভারি খুশি হইয়া ক্লাশে আসিতেছিল—এমন সময় নুতন পণ্ডিতমহাশয় “হাসছ কেন” বলিয়া হঠাৎ এমন ধমক দিয়া উঠিলেন যে মুখের হাসি এক মুহর্তে আকাশে উড়িয়া গেল। তাহার পরদিন আমাদের ক্লাশের বাইরে রাস্তার ধারে কে যেন হো-হো করিয়া হাসিতেছিল। শুনিয়া পণ্ডিতমহাশয় পাশের ঘর হইতে হাঁ-হা করিয়া ছুটিয়া আসিলেন। আসিয়া আর কথাবার্তা নাই—“কেবল হাসি?” বলিয়া হরিপ্রসন্নর গালে ঠাস ঠাস্ করিয়া কয়েক চড় লাগাইয়া আবার হো-হো করিয়া চলিয়া গেলেন। সেই অবধি হরিপ্রসন্নর উপর তিনি বিনা কারণে—যখন তখন খাপ হইয়া উঠিতেন।

 দেখিতে দেখিতে স্কুলসুদ্ধ ছেলে নুতন পণ্ডিতের উপর হাড়ে চটিয়া গেল। একদিন আমাদের অঙ্কের মাস্টার আসেন নাই। হেডমাস্টার রামবাবু বলিয়া গেলেন-তোমরা ক্লাশে বসিয়া পুরাতন পড়া পড়িতে থাক। আমরা পড়িতে লাগিলাম, কিন্তু খানিক বাদেই পণ্ডিতমহাশয় পাশের ঘর হইতে, “পড়ছ না কেন?” বলিয়া টেবিলে প্রকাণ্ড এক ঘুষি মারিলেন। অমির বলিলাম, “আজ্ঞে হ্যা, পড়ছি তো।” তিনি আবার বলিলেন “তবে শুনতে পাচ্ছি না কেন, চেঁচিয়ে পড়।”, যেই বলা অমনি বোকা ফকিরচাঁদ,

“অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড—”

ইস্কুলের গল্প
১০৩