পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চীনে পটকা

 আমাদের রামপদ একদিন এক হাঁড়ি, মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল! টিফিনের ছুটি হওয়ামাত্র আমরা সকলেই মহা উৎসাহে সেগুলি ভাগ করিয়া খাইলাম। খাইল না কেবল ‘পাগলা দাশু'।

 পাগলা দাশু যে মিহিদানা খাইতে ভালোবাসে না, তা নয়। কিন্তু, রামপদকে সে একেবারেই পছন্দ করিত না-দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলিত! আমরা রামপদকে বলিলাম, “দাশুকে কিছু দে!” রামপদ বলিল, “কি রে দাশু, খাবি নাকি? দেখিস, খাবার লোভ হয়ে থাকে তো বল আর আমার সঙ্গে কোনোদিন লাগতে আসবি নে-তা হলে মিহিদানা পাবি।” এমন করিয়া বলিলে তো রাগ হইবারই কথা, কিন্তু দাশু কিছু, না বলিয়া গম্ভীরভাবে হাত পাতিয়া মিহিদানা লইল, তার পর দরোয়ানের কুকুরটাকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে সেই মিহিদানা খাওয়াইল! তার পর খানিকক্ষণ হাঁড়িটার দিকে তাকাইয়া কি যেন ভাবিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে হাসিতে স্কুলের বাহিরে চলিয়া গেল। এদিকে হাঁড়িটাকে শেষ করিয়া আমরা সকলে খেলায় মাতিয়া গেলাম—দাশুর কথা কেউ আর ভাবিবার সময় পাই নাই।

 টিফিনের পর ক্লাশে আসিয়া দেখি দাশু অত্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে এককোণে বসিয়া আপন মনে অঙ্ক কষিতেছে। তখনই আমাদের কেমন সন্দেহ হইয়াছিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি রে দাশু, কিছু করেছিস নাকি?” দাশু নিতান্ত ভালোমানুষের মতো বলিল, “হ্যাঁ, দুটো জি-সি-এম করে ফেলেছি।” আমরা বলিলাম, “দুৎ! সে কথা কে বলছে? কিছু দুষ্টুমির মতলব করিস নি তো?” এ কথায় দাশু ভয়ানক চটিয়া গেল। তখন পণ্ডিতমহাশয় ক্লাশে আসিতেছিলেন, দাশু তাহার কাছে নালিশ করে আর কি! আমরা অনেক কষ্টে তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া বসাইয়া রাখিলাম।

 এই পণ্ডিতমহাশয় মানুষটি মন্দ নহেন। পড়ার জন্য কোনোদিনই তাড়াহুড়া করেন না। কেবল মাঝে মাঝে একটু বেশি গোল করিলে হঠাৎ সাংঘাতিকরকম চটিয়া যান। সে সময়ে তাঁর মেজাজটি আশ্চর্যরকম ধারালো হইয়া উঠে। পণ্ডিতমহাশয় চেয়ারে বসিয়াই, “নদী শব্দের রূপ কর” বলিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমরা বই খুলিয়া, হড়্ বড়্, করিয়া যা তা খানিকটা বলিয়া গেলাম-এবং তাহার উত্তরে পণ্ডিতমহাশয়ের নাকের ভিতর হইতে অতি সুন্দর ঘড়্‌ঘড়্ শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম নিদ্রা বেশ গভীর হইয়াছে। কাজেই আমরাও শ্লেট লইয়া ‘টুকটাক্’ আর ‘দশ-পঁচিশ’ খেলা শুরু করিলাম। কেবল মাঝে মাঝে যখন ঘড় ঘড়ানি কমিয়া আসিত-তখন সবাই মিলিয়া সুর করিয়া নদী নদ্যৌ নদ্যঃ' ইত্যাদি আওড়াইতাম। দেখিতাম, তাহাতে, ঘুমপাড়ানি গানের ফল খুব আশ্চর্যরকম পাওয়া যায়।

১১০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২