পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চালিয়াৎ

 শ্যামচাঁদ আমাদের নীচের ক্লাশে পড়িত, কিন্তু তার দেমাকের দৌরাত্ম্যে সমস্ত স্কুলসুদ্ধ ছেলে অস্থির হইয়া থাকিত। শ্যামচাঁদের বাবা কোন একটা সাহেব অফিসে বড়ো কাজ করিতেন, তাই শ্যামাদের পোশাক-পরিচ্ছদে রকম-সকমে কায়দার আর অন্ত ছিল না। সে যখন দেড় বিঘৎ চওড়া 'কলার’ আঁটিয়া রঙিন ছাতা মাথায় দিয়া নূতন জুতার মচ্‌মচ্ শব্দে গম্ভীর চালে ঘাড় উঁচাইয়া স্কুলে আসিত—তাহার সঙ্গে পাগড়িবাঁধা তকমাআঁটা চাপরাশি এক রাজ্যের বই ও টিফিনের বাক্স বহিয়া আনিত–তখন তাহাকে দেখাইত ঠিক যেন পেখমধরা ময়ূরটির মতো। স্কুলের ছোটো-ছোটো ছেলেরা হাঁ করিয়া অবাক হইয়া থাকিত, কিন্তু আমরা সবাই একবাক্যে বলিতাম—‘চালিয়াৎ'।

 বয়সের হিসেবে শ্যামচাঁদ একটু বেঁটে ছিল। পাছে কেহ তাহাকে ছেলেমানুষ ভাবে এবং যথোপযুক্ত খাতির না করে, এইজন্য সর্বদাই সে অনাবশ্যকরকম গম্ভীর হইয়া থাকিত এবং কথাবার্তায় ধরনে-ধারণে ইংরাজি বোলচাল দিয়া এমন বিজ্ঞের মতো ভাবপ্রকাশ করিত, যে স্কুলের দরোয়ান হইতে নীচের ক্লাশের ছাত্র পর্যন্ত সকলেরই তাক লাগিয়া যাইত। সকলেই ভাবিত, ‘নাঃ, লোকটা কিছু জানে!' শ্যামচাঁদ প্রথম যেবার ঘড়ি-চেইন আঁটিয়া স্কুলে আসিল, তখন তাহার কাণ্ড যদি দেখিতে! পাঁচমিনিট অন্তর ঘড়িটাকে বাহির করিয়া সে কানে দিয়া শুনিত ঘড়িটা চলে কি না! স্কুলের যেখানে যত ঘড়ি আছে সব কটার ভুল তাহার দেখানো চাইই চাই! পাঁড়েজি দরোয়ানকে সে একদিন রীতিমতো ধমক লাগাইয়া বসিল-“এই! স্কুলের ক্লকটাতে যখন চাবি দাও তখন সেটাকে রেগুলেট কর না কেন? ওটাকে অয়েল করতে হবে—ক্রমাগতই স্লো চলছে।” পাঁড়েজির চৌদ্দপুরুষে কেউ কখনো ঘড়ি ‘অয়েল' বা ‘রেগুলেট’ করে নাই। সে যে সপ্তাহে একদিন করিয়া চাবি ঘুরাইতে শিখিয়াছে, ইহাতেই তাহার দেশের লোকের বিস্ময়ের সীমা নাই। কিন্তু দেশভাইদের কাছে মানরক্ষা করিবার জন্য সে ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “হাঁ, হাঁ, আভি হাম রেংলিট করবে।” পাঁড়েজির উপর এক চাল চালিয়া শ্যামাচাঁদ ক্লাশে ফিরিতেই কতগুলা ছোটো ছেলে তাহাকে ঘিরিয়া ফেলিল-শ্যামচাঁদ তাহাদের কাছে মহা আড়ম্বর করিয়া স্লো, ফাস্ট, মেইন স্প্রিং, রেগুলেট প্রভৃতি ঘড়ির সমস্ত রহস্য ব্যাখ্যা করিতে লাগিল। ব্যাপার দেখিয়া আমরা সবাই বলিলাম, “চালিয়াৎ!”

 একবার আমাদের একটি নূতন মাস্টার আসিয়াছিলেন, তিনি শ্যামচাঁদকে বেজায় অপ্রস্তুত করিয়াছিলেন। প্রথমত তিনি ক্লাশে আসিয়াই শ্যামচাঁদকে 'খোকা' বলিয়া সম্বোধন করিলেন। লজ্জায় ও অপমানে শ্যামচাঁদের মুখ কান একেবারে লাল হইয়া উঠিল—সে আমৃতা-আম্তা করিয়া বলিল, “আজ্ঞে, আমার নাম শ্যামচাঁদ ঘটক।” মাস্টারমহাশয় অত কি বুঝিবেন—“শ্যামচাঁদ? আচ্ছা বেশ, খোকা বস।” তার পর কয়েকদিন ধরিয়া স্কুলসুদ্ধ ছেলে তাহাকে ‘খোকা, খোকা' করিয়া অস্থির করিয়া তুলিল।

ইস্কুলের গল্প
১১৩