পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেখি একবার চেপে-”। ভুতোর বাড়ি বাঙাল দেশে—তার মেজাজটি যখন মাত্রায় চড়ে তখন তার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না—সে একটা ছোকরার কানে প্রকাণ্ড এক কিল বসাইয়া দিল। কিল খাইয়াই সে হতভাগা একেবারে “গোব্‌রা দা” বলিয়া চীৎকার দিয়া উঠিল, আর সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিনজনও “গোব্‌রা দা, গোব্‌রা দা” বলিয়া এমন একটা হৈ চৈ রব তুলিল, যে আমরা ব্যাপারটা কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া একেবারে হতভম্ব হইয়া রহিলাম। এমন সময় একটা কুচকুচে কালো মুতি হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া দেখা দিল। আসিয়াই আর কথাবার্তা না বলিয়া ভুতোর ঘাড়ে ধাক্কা মারিয়া, গুপের কান মুলিয়া, আমার গালে খামখা ঠাস্ ঠাস্ করিয়া দুই চড় লাগাইয়া দিল। তার পর কাহার কি হইল আমি খবর রাখিতে পারি নাই। মোট কথা, সেদিন আমাদের যতটা অপমানবোধ হইয়াছিল, ভয় হইয়াছিল তাহার চাইতেও বেশি। সেই হইতে গোব্‌রার নাম শুনিলেই ভয়ে আমাদের মুখ শুকাইয়া আসিত॥

পালোয়নের কেরামতির পরিচয় পাইয়া আমাদের মনে ভরসা আসিল। আমরা ভাবিলাম, এবার যেদিন পাঠশালার ছেলেগুলা আমাদের ভ্যাংচাইতে আসিবে, তখন আমরাও আরো বেশি করিয়া ভ্যাংচাইতে ছাড়িব না। পালোয়ানও এ কথায় খুব উৎসাহ প্রকাশ করিল। কিন্তু অনেকদিন অপেক্ষা করিয়াও যখন তাহাদের ঝগড়া বাধাইবার আর কোনো মতলব দেখা গেল না, তখন আমাদের মনটা খুঁৎখুঁৎ করিতে লাগিল। আমরা বলিতে লাগিলাম, “ওরা নিশ্চয়ই পালোয়ানের কথা শুনতে পেয়েছে।” পালোয়ান বলিল, “ঁহ্যা, তাই হবে। দেখছ না, এখন আর বাছাদের টুঁ শব্দটি নেই।” তখন সবাই মিলিয়া স্থির করিলাম যে পালোয়ানকে সঙ্গে লইয়া গোব্‌রার দলের সঙ্গে ভালোরকম বোঝাপড়া করিতে হইবে।

শনিবার দুইটার সময় স্কুল ছুটি হইয়াছে, এমন সময়ে কে যেন আসিয়া খবর দিল যে গোব্‌রা চার-পাঁচটি ছেলেকে সঙ্গে লইয়া পুকুরপাড়ে বসিয়া গল্প করিতেছে। যেমন শোনা অমনি দলেবলে হৈ হৈ করিতে করিতে সেখানে হাজির। আমাদের ভাবখানা দেখিয়াই বোধ হয় তাহারা বুঝিয়াছিল যে, আমরা কেবল বন্ধুভাবে আলাপ করিতে আসি নাই। তাহারা শশব্যস্ত হইয়া উঠিতে না উঠিতেই আমরা তিন-চারজনে মিলিয়া গোব্‌রাকে একেবারে চাপিয়া ধরিলাম। সকলেই ভাবিলাম, এ যাত্রায় গোব্‌রার আর রক্ষা নাই। কিন্তু আহাম্মক রামপদটা একেবারে সব মাটি করিয়া দিল। সে বোকারাম ছাতা হাতে হাঁ করিয়া তামাশা দেখিতেছিল। এমন সময় পাঠশালার একটা ছোকরা এক থাবড়া মারিয়া তাহার ছাতাটা কাড়িয়া লইল। আমরা ততক্ষণে গোরাচাঁদকে প্রায় চিৎপাত করিয়া আনিয়াছি, এমন সময় হঠাৎ আমাদের ঘাড়ে পিঠে ডাইনে বাঁয়ে ধপাধপ ছাতার বৃষ্টি শুরু হইল। আমরা মুহুর্তের মধ্যে একেবারে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িলাম, আর সেই ফাঁকে গোব্‌রাও একলাফে গা ঝাড়া দিয়া উঠিল। তাহার পর চক্ষের নিমেষে তাহারা আমাদের চার-পাঁচজনকে ধরিয়া পুকুরের জন্মে ভালোরকমে চুবাইয়া রীতিমতো নাকাল করিয়া ছাড়িয়া দিল। এই বিপদের সময় আমাদের দলের আর সকলে কে যে কোথায় পলাইল, তাহার আর কিনারাই করা গেল না। সবচাইতে আশ্চর্য এই যে, ইহার মধ্যে পালোয়ান যে

ইস্কুলের গল্প
১১৭