পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 একদিন টিফিনের সময় উঠানে বড়ো সিড়িটার উপর একদল ছেলের সঙ্গে বসিয়া সবজান্তা গল্প আরম্ভ করিল, “আমি একদিন দার্জিলিঙে লাটসাহেবের বাড়ির কাছের ঐ রাস্তাটায় বেড়াচ্ছি-এমন সময় দেখি রামলালবাবু হাসতে হাসতে আমার দিকে আসছেন, তাঁর সঙ্গে আবার এক সাহেব। রামলালবাবু বললেন, “দুলিরাম! তোমার সেই ইংরাজি কবিতাটা একবার এঁকে শোনাতে হচ্ছে। আমি এঁর কাছে তোমার সুখ্যাত করছিলাম, তাই ইনি সেটা শুনবার জন্য ভারি ব্যস্ত হয়েছেন।” উনি নিজে থেকে বলছেন, তখন আমি আর কি করি? আমি সেই Casabianca থেকে আবৃত্তি করলুম-তার পর দেখতে যা ভিড় জমে গেল! সবাই শুনতে চায়, সবাই বলে ‘আবার কর'। মহামুস্কিলে পড়ে গেলাম, নেহাৎ রামলালবাবু বললেন তাই আবার করতে হল।” এমন সময়, কে যেন পিছন হইতে জিজ্ঞাসা করিল “রামলালবাবু কে?” সকলে ফিরিয়া দেখি, একটি রোগা নিরীহগোছের পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোক সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া আছেন। সবজান্তা বলিল, “রামলালবাবু কে, তাও জানেন না? লোহারপুরের জমিদার রামলাল রায়।” ভদ্রলোকটি অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন, “হাঁ তার নাম শুনেছি-সে তোমার কেউ হয় নাকি?” “না কেউ হয় না-এমনি, খুব ভাব আছে আমার সঙ্গে। প্রায়ই চিঠিপত্র চলে।” তদ্রলোকটি আবার বলিলেন, “রামলালবাবু লোকটি কেমন?” সবজান্তা উৎসাহের সঙ্গে বলিয়া উঠিল, “চমৎকার লোক। যেমন চেহারা, তেমনি কথাবার্তা, তেমনি কায়দাদুরস্ত। এই আপনার চেয়ে প্রায় আধ হাতখানেক লম্বা হবেন, আর সেইরকম তাঁর তেজ! আমাকে তিনি কুস্তি শেখাবেন বলেছিলেন, আর কিছুদিন থাকলেই ওটা বেশ রীতিমতো শিখে আসতাম।” ভদ্রলোকটি বলিলেন, “বল কি হে? তোমার বয়স কত?” আজ্ঞে এইবার তেরো পূর্ণ হবে।” “বটে! বয়সের পক্ষে খুব চালাক তো! বেশ তো কথাবার্তা বলতে পার। কি নাম হে তোমার?” সবজান্তা বলিল, “দুলিরাম ঘোষ। রণদাবাবু ডেপুটি আমার মামা হন।” শুনিয়া ভদ্রলোকটি ভারি খুশি হইয়া হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরের দিকে ঢলিয়া গেলেন।

 ছুটির পর আমরা সকলেই বাহির হইলাম। স্কুলের সম্মুখেই ডেপটিবাবুর বাড়ি, তাহার বাহিরের বারান্দায় দেখি সেই ভদ্রলোকটি বসিয়া দুলিরামের ডেপুটি মামার সঙ্গে গল্প করিতেছেন। দুলিরামকে দেখিয়াই মামা ডাক দিয়া বলিলেন, “দুলি এদিকে অয়ি, একে প্রণাম কর। এটি আমার ভাগনে দুলিরাম।” ভদ্রলোকটি হাসিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, এর পরিচয় আমি আগেই পেয়েছি।” দুলিরাম আমাদের দেখাইয়া খুব আড়ম্বর করিয়া ভদ্রলোকটিকে প্রণাম করিল। ভদ্রলোকটি বলিলেন, “কেমন? আমায় তো তুমি জানই?” দুলি বলিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ আজ স্কুলে দেখেছিলাম।” ভদ্রলোকটি আবার বলিলেন, “আমার পরিচয় জান না বুঝি?” সবজান্তা এবার আর ‘জানি’ বলিতে পারিল না, অম্‌তা-অম্‌তা করিয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল। ভদ্রলোকটি তখন বেশ একটু মুচকি মুচকি হাসিয়া আমাদের শুনাইয়া বলিলেন, “আমার নাম রামলাল রায়, লোহারপুরের রামলাল রায়।”

 দুলিরাম খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল—তার পর মুখখানা লাল করিয়া হঠাৎ এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া-গেল। ব্যাপার দেখিয়া ছেলেরা রাস্তার উপর হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল। তার পরের দিন আমরা স্কুলে আসিয়া দেখিলাম—সবজান্তা আসে

ইস্কুলের গল্প
১২১

 সু. স. র-২-১৫