পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নাই-তাহার নাকি মাথা ধরিয়াছে। নানা অজুহাতে সে দু-তিনদিন কামাই করিল—তাহার পর যেদিন সে স্কুলে আসিল তখন তাহাকে দেখিবামাত্র তাহারই কয়েকজন চেলা, “কি হে! রামলালবাবুর চিঠিপত্র পেলে?” বলিয়া তাহাকে একেবারে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তার পর যতদিন সে স্কুলে ছিল, ততদিন তাহাকে খেপাইতে হইলে বেশি কিছু করার দরকার হইত না, খালি একটিবার রামলালবাবুর খবর জিজ্ঞাসা করিলেই বেশ তামাশা দেখা যাইত।

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৪


নন্দলালের মন্দ কপাল

 নন্দলালের ভারি রাগ, অঙ্কের পরীক্ষায় মাষ্টার তাহাকে “গোল্লা দিয়াছেন। অবশ্য সে যে খুব ভালো লিখিয়াছিল তাহা নয়, কিন্তু তা বলিয়া একেবারে গোল্লা দেওয়া কি উচিত ছিল? হাজার হোক, সে একখানা পুরা খাতা লিখিয়াছিল তো! তার পরিশ্রমের কি কোনো মুল্য নাই? ঐ যে ত্রৈরাশিকের অঙ্কটা সেটা তো তার প্রায় ঠিকই হইয়াছিল, কেবল একটুখানি হিসাবের ভুল হওয়াতে উত্তরটা ঠিক মেলে নাই। আর ঐ যে একটা ডেসিম্যালের অঙ্ক ছিল, সেটাতে গুণ করিতে গিয়া সে ভাগ করিয়া বসিয়াছিল, তাই বলিয়া কি একটা নম্বরও দিতে নাই? আরো অন্যায় এই যে, এই কথাটা মাষ্টারমহাশয় ক্লাশের ছেলেদের কাছে ফাঁস করিয়া ফেলিয়াছেন। কেন? আরেকবার হরিদাস যখন গোল্লা পাইয়াছিল, তখন তো সে কথাটা রাষ্ট্র হয় নাই। এ ভারি অন্যায়।

 কেহ কেহ বলিল, “নন্দলাল চটো কেন? গোল্লা পাইয়াছ, তার জন্য কোথায় লজ্জিত ওয়া উচিত, না তুমি খামখা রাগিয়াই অস্থির।” নন্দলাল রাগিয়া আগুন হইল। কি। এতবড়ো কথা। সে যে ইতিহাসে একশোর মধ্যে পঁচাশি পাইয়াছে, সেটা বুঝি কিছু নয়? খালি অঙ্কে ভালো পারে নাই বলিয়াই তাহাকে লজ্জিত হইতে হইবে? সব বিষয়েই যে সকলকে ভালো পারিতে হইবে, তাহারই-বা অর্থ কি? স্বয়ং নেপোলিয়ান যে ছেলেবেলায় ব্যাকরণে একেবারে আনাড়ি ছিলেন, সে বেলা কি? তাহার এই যুক্তিতে ছেলেরা দমিল না এবং মাস্টারদের কাছে এই তর্কটা তোলাতে তাহারাও যে যুক্তিটাকে খুব চমৎকার ভাবিলেন, এমন তো বোধ হইল না। তখন নন্দলাল বলিল, তাহার কপালই মন্দ—সে নাকি বরাবর তাহা দেখিয়া আসিতেছে।

 সেই তো যেবার ছুটির আগে তাহাদের পাড়ায় হাম দেখা দিয়াছিল, তখন বাড়িসুদ্ধ সকলেই হামে ভুগিয়া দিব্যি মজা করিয়া স্কুল কামাই করিল, কেবল বেচারা নন্দলালকেই নিয়মমতো প্রতিদিন স্কুলে হাজিরা দিতে হইয়াছিল। তার পর যেমন ছুটি আরম্ভ হইল, অমনি তাহাকেও জ্বরে আর হামে ধরিল—সমস্ত ছুটিটাই মাটি। সেই যেবার সে মামারবাড়ি গিয়াছিল, সেবার তাহার মামাতো ভাইয়েরা কেহবাড়ি ছিল না—ছিলেন কোথাকার এক বদমেজাজি মেসো, তিনি উঠিতে বসিতে কেবল ধমক আর শাসন ছাড়া আর কিছু জানিতেন না। তার উপর সেবার এমন বৃষ্টি হইয়াছিল যে একদিনও ভালো করিয়া

১২২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২