পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আপত্তি করব না। আমি জানি, এ-সমস্ত নেহাত যেমন-তেমন চোরের সাধ্য নয়—আমার খুব বিশ্বাস, যে লোকটা আমাদের বাড়িতে চুরি করেছিল, এ-সব তারই কাণ্ড!”

 এমন সময়ে হঠাৎ টিফিন ঘরের বাঁদিকের জানলাটা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল, যেন কেউ ভেতর থেকে ঠেলছে। তার পরেই সাদা মতন কি—একটা ঝুপ করে উঠোনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। আমরা চেয়ে দেখলাম একটা মোটা হুলো বেড়াল, তার মুখে জলধরের সরভাজা। তখন যদি জলধরের মুখখানা দেখতে, সে এক বিঘৎ উঁচু হাঁ করে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন হে ডিটেক্‌টিভ। ঐ ষণ্ডা চোরটাই তো তোমার বাড়িতে চুরি করেছিল? তা হলে এখন ওকেই পুলিসে দেই?”

সন্দেশ-কার্তিক, ১৩২৪


বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়

 বিষ্ণুবাহন খাসা ছেলে। তাহার নামটি যেমন জমকাল, তাহার কথাবার্তা চালচলনও তেমনি। বড়ো-বড়ো গম্ভীর কথা তাহার মুখে যেমন শোনাইত, এমন আর কাহারও মুখে শুনি নাই। সে যখন টেবিলের উপর দাঁড়াইয়া হাত-পা নাড়িয়া ‘দুঃশাসনের রক্তপান’ অভিনয় করিত, তখন আমরা সবাই উৎসাহে হাততালি দিয়া উঠিতাম, কেবল দু-একজন হিংসুটে ছেলে নাক সিটকাইয়া বলিত, “ওরকম ঢের ঢের দেখা আছে।” ভুতো এই হিংসুক দলের সর্দার। সে বিষ্ণুবাহনকে ডাকিত 'খগা'। কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, “বিষ্ণুবাহন মানে গরুড়, আর গরুড় হচ্ছেন খগরাজ-খগরাজ পায় লাজ নাসিকা অতুল—তাই বিষ্ণুবাহন হলেন খগা।” বিষ্ণবাহন বলিল, “ওরা আমার নামটাকে পর্যন্ত হিংসে করে।”

 বিষ্ণুবাহনের কে এক মামা 'চন্দ্রদ্বীপের দিগিজয়' বলে একখানা নতুন নাটক লিখিয়াছেন। বিষ্ণুবাহন একদিন সেটা আমাদের পড়িয়া শোনাইল। শুনিয়া আমরা সকলেই বলিলাম, “চমৎকার!” বিশেষত, যে জায়গায় চন্দ্রদ্বীপ, “আয় আয় কাপুরুষ, আয় শত্রু আয় রে” বলিয়া নিষাদরাজার সিংহদরজায় তলোয়ার মারিতেছেন। সেই জায়গাটা পড়িতে পড়িতে বিষ্ণুবাহন যখন হঠাৎ “আয় শত্রু আয়” বলিয়া ভুতোর ঘাড়ে ছাতার বাড়ি মারিল, তখন আমাদের এমন উৎসাহ হইয়াছিল যে আর-একটু হইলেই একটা মারামারি বাধিয়া যাইত। আমরা তখনই ঠিক করিলাম যে ওটা ‘অ্যাকটিং' করিতে হইবে।

 ছুটির দিন আমাদের অভিনয় হইবে, তাহার জন্য ভিতরে ভিতরে সব আয়োজন চলিতে লাগিল। রোজ টিফিনের সময় আর ছুটির পরে আমাদের তর্জন-গর্জনে পাড়াসুদ্ধ লোক বুঝিতে পারিত যে, একটা কিছু কাণ্ড হইতেছে। বিষ্ণুবাহন চন্দ্রদ্বীপ সাজিবে, সেই আমাদের কথাবার্তা শিখাইত আর অঙ্গভঙ্গি লম্ফঝম্ফ সব নিজে করিয়া দেখাইত। ভুতোর দল প্রথমটা খুব ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিয়াছিল, কিন্তু যেদিন বিষ্ণুবাহন কোথা হইতে একরাশ নকল গোঁফদাড়ি, কতগুলা তীর-ধনুক, আর রূপালি কাগজ মোড়া কাঠের তলোয়ার আনিয়া হাজির করিল, সেইদিন তাহারা হঠাৎ কেমন মুষড়াইয়া গেল।

ইস্কুলের গল্প
১২৭