পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নাড়িয়া শেষটায় নাটকের বইয়ের উপর এক কালির বোতল উলটাইয়া ফেলিল, এবং তাড়াতাড়ি রুমাল বাহির করিয়া কালি মুছিতে লাগিল। ততক্ষণে এদিকে দ্বিতীয় দৃশ্যের ঘণ্টা পড়িয়াছে।

 বিষ্ণুবাহন ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া আবার আসরে নামিতে গিয়ই পা হড়কাইয়া প্রকাণ্ড এক আছাড় খাইল। দেখিয়া লোকেরা কেহ হাসিল, কেহ আহা আহা করিল, আর সব গোলমালের উপর সকলের চাইতে পরিষ্কার শোনা গেল ভুতোর চড়া গলার চীৎকার, “বাহবা বিষ্ণুবাহন।” বিষ্ণুবাহন বেচারা এমন অপ্রস্তুত হইয়া গেল যে সেখানে যাহা বলিবার তাহা বেমালুম ভুলিয়া, “সেনাপতি। এই কি সে রত্নগিরিপুর” বলিয়া একেবারে চতুর্থ দৃশ্যের কথা আরম্ভ করিল। আমি কানে কানে বলিলাম, “ওটা নয়”, তাহাতে সে আরো ঘাবড়াইয়া গেল। তাহার মুখে দরদর করিয়া ঘাম দেখা দিল, সে কয়েকবার ঢোক গিলিয়া, তার পর রুমাল দিয়া মুখ মুছিতে লাগিল। রুমালটি আগে হইতেই কালিমাখা হইয়াছিল, সুতরাং তাহার মুখখানার চেহারা এমন অপরূপ হইল, যে আমাদেরই হাসি চাপিয়া রাখা মুস্কিল হইল। ইহার উপর সে যখন ঐ চেহারা লইয়া, ভাঙা-ভাঙা গলায় “কোথায় পালাবে তারা শৃগালের প্রায়” বলিয়া বিকট আস্ফালন করিতে লাগিল। তখন ঘরসুদ্ধ লোক হাসিয়া গড়াগড়ি দিবার জোগাড় করিল। বিষ্ণুবাহন বেচারা কিছুই জানে না, সে ভাবিল, শ্রোতাদের কোথাও একটা কিছু ঘটিয়াছে, তাই সকলে হাসিতেছে। সুতরাং সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য আরো উৎসাহে হাত-পা ছুড়িয়া ভীষণ রকম তর্জন-গর্জন করিয়া স্টেজের উপর ঘুরিতে লাগিল। ইহাতেও হাসি ক্রমাগতই বাড়িতেছে দেখিয়া তাহার মনে কি যেন সন্দেহ হইল। সে হঠাৎ আমাদের দিকে ফিরিয়া দেখে আমরাও প্রাণপণে হাসিতেছি—এবং তাহাকে লক্ষ্য করিয়াই হাসিতেছি। তখন রাগে একেবারে দিগ্বিদিক ভুলিয়া সে তাহার তলোয়ার দিয়া বিশুর পিঠে সপাং করিয়া এক বাড়ি মারিল। বিশু চন্দ্রদ্বীপের মন্ত্রী, তাহার মার খাইবার কথাই নয়, সুতরাং সে ছাড়িবে কেন? সে ঠাস্ ঠাস্ করিয়া বিষ্ণুবাহনের গালে দুই চড় বসাইয়া দিল। তখন সেই স্টেজের উপরেই সকলের সামনে দুজনের মধ্যে একটা ভয়ানক হুড়াহুড়ি কিলাকিলি বাধিয়া গেল। প্রথমে, প্রায় সকলেই ভাবিয়াছিল ওটা অভিনয়ের লড়াই। সুতরাং অনেকে খুব হাততালি দিয়া উৎসাহ দিতে লাগিল। কিন্তু বিষ্ণুবাহন যখন দস্তুরমতো মার খাইয়া, “দেখুন দেখি স্যার, মিছিমিছি মারছে কেন” বলিয়া কাঁদ-কাঁদ গলায় হেডমাস্টার মহাশয়ের কাছে নালিশ জানাইতে লাগিল, তখন ব্যাপারখানা বুঝিতে আর কাহারও বাকি রহিল না।

 ইহার পর, সেদিন যে আর অভিনয় হইতেই পারে নাই, এ কথা আর বুঝাইয়া বলিবার দরকার নাই। ছুটি হইবার তিনদিন পরেই বিষ্ণুবাহন তাহার মামারবাড়ি চলিয়া গেল। ঐ তিনদিন সে বাড়ি হইতে বাহির হয় নাই, কারণ তাহাকে দেখিলেই ছেলেরা চেঁচায়, “বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়!” ইস্কুলের গায়ে রাস্তার ধারে প্ল্যাকার্ড মারা ‘বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়’-এমন-কি, বিষ্ণুবাহনের কড়ির দরজায় খড়ি দিয়া বড়ো-বড়ো অক্ষরে লেখা-

‘বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়’
সন্দেশ- ফাল্গুন, ১৩২৪
ইস্কুলের গল্প
১২৯