পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মেরেছ?” কালাচাঁদ বলিল, “আজ্ঞে না, মারব কেন? কান মলে দিয়েছিলাম, গালে খাম্‌চিয়ে দিয়েছিলাম, আর একটুখানি চুল ধরে ঝাঁকিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলাম।” হেডমাস্টার বলিলেন, “কেন ওরকম করেছিলে?” কালাচাঁদ খানিকটা অম্‌তা-অম্‌তা করিয়া মাথা চুলকাইয়া বলিল, “আজ্ঞে, ও খালি খালি আমায় চটাচ্ছিল।” হেডমাস্টার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমায় মেরেছিল?” “না”। “তোমায় গাল দিয়েছিল?” “না!” “ধমকিয়েছিল?” “না।” “তবে?” “বার বার ঘ্যান্‌ঘ্যান্ করে বোকার মতো কথা বলছিল, তাই আমার রাগ হয়ে গেল।” মাস্টারমহাশয় তাহার কান ধরিয়া বেশ ভালোরকম নাড়াচাড়া দিয়া বলিলেন, “মেজাজটা এখন হইতে একটু সংশোধন করিতে চেষ্টা কর।”

 ছুটির পর আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, “হ্যাঁরে কালাচাঁদ, তুই খামখা ঐ নিধেটাকে মারতে গেলি কেন?” কালাচাঁদ বলিল, “খামখা মারব কেন? কেন মেরেছিলাম ওকেই জিজ্ঞেসা কর-না!” নিধেকে জিজ্ঞাসা করিতে সে বলিল, “খামখা নয়তো কি? তুই বাপু ছবি এঁকেছিস—তার কথা আমায় জিজ্ঞাসা করতে গেলি কেন? আর যদি জিজ্ঞেস করলি, তা হলে তাই নিয়ে আবার মারামারি করতে এলি কেন?” আমরা বলিলাম, “আরে কি হয়েছে খুলেই বল্-না কেন।”

 নিধিরাম বলিল, “কালাচাঁদ একটা ছবি এঁকেছে—ছবির নাম ‘খাণ্ডবদাহন'। সেই ছবিটা আমায় দেখিয়ে ও জিজ্ঞাসা করল, কেমন হয়েছে? আমি বললাম, “এটা কি এঁকেছ? মন্দিরের সামনে শেয়াল ছুটছে? কালাচাঁদ বলল, “না না মন্দির কোথায়? ওটা হল রথ। আর এগুলো তো শেয়াল নয়-রথের ঘোড়া।' আমি বললাম, “সূর্যটাকে কালো করে একেছ কেন? আর তালগাছের উপরে পদ্মফুল ফুটেছে কেন? আর ঐ চামচিকেটা লাঠি নিয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে কেন? কালাচাঁদ বলল, “আহা তা কেন? ওটা তো সূর্য নয়, সুদর্শন চক্র! দেখছ না কৃষ্ণের হাতে রয়েছে? আর তালগাছ কোথায় দেখলে? ওটা তো অজুনের পতাকা। আর ঐগুলোকে বুঝি পদ্মফুল বলছ? ওগুলো দেবতা-খুব দূরে আছেন কিনা তাই ওরকম ছোটো-ছোটো দেখাচ্ছে। আর এইটা বুঝি চামচিকে হল—এটা তো গরুড় পাখি। একটা সাপকে তাড়া করেছে। আমি বললাম, “তা হবে। আমি ও-সব বুঝি-টুঝি না। আচ্ছা ঐ কালো কাপড় পরা মেয়েমানুষটি যে ওদের মারতে আসছে ওটি কে? কালাচাঁদ বললে, তুমি তো আচ্ছা মুখ্যু হে! ওটা গাছে আগুন লেগে ধোঁয়া বেরুচ্ছে বুঝতে পাচ্ছ না? অবাক করলে যে!'

 “তখন আমি বললাম, “অচ্ছিা এক কাজ কর-না কেন ভাই, ওটাকে খাণ্ডবদাহন না করে সীতার অগ্নিপরীক্ষা কর-না কেন? ঐ গাছটাকে শাড়ি পরিয়ে সীতা করে দাও। ঐ রথটার মাথায় জটা-টটা দিয়ে ওকে অগ্নিদেব বানাও। কৃষ্ণ অর্জুন আছেন, তারা হবেন রাম লক্ষণ। আর ঐ সুদর্শন চক্রে নাক হাত পা জুড়ে দিলেই ঠিক বিভীষণ হয়ে যাবে। তার পর চামচিকের পিছনে একটা লম্বা ল্যাজ দিয়ে তার ডানাদুটো মুছে দাও—এটা হনুমান হবে এখন।' কালাচাঁদ বলল, 'হনুমানও হতে পারে, নিধিরামও হতে পারে।'

 “আমি বললাম, 'তা হলে ভাই আর-এক কাজ কর। ওটাকে শিশুপাল বধ করে দাও। তা হলে কৃষ্ণকে বদলাতে হবে না। চক্র তুলে শিশুপালকে মারতে যাচ্ছে!

ইস্কুলের গল্প
১৩৩