পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভোলানাথের সর্দারি

 সকল বিষয়েই সর্দারি করিতে যাওয়া ভোলানাথের ভারি একটা বদঅভ্যাস। যেখানে তাহার কিছু বলিবার দরকার নাই সেখানে সে বিজ্ঞের মতো উপদেশ দিতে যায়। যে কাজের সে কিছুমাত্র বোঝে না, সেই কাজেও সে চটপট হাত লাগাইতে ছাড়ে না। এইজন্য গুরুজনেরা তাহাকে বলেন ‘জ্যাঠা’-আর সমবয়সীরা বলে ‘ফড়্‌ ফড়িরম'। কিন্তু তাহাতে তাহার কোনো দুঃখ নাই, বিশেষ লজ্জাও নাই। সেদিন তাহার তিন ক্লাশ উপরের বড়ো-বড়ো ছেলেরা যখন নিজেদের পড়াশুনা লইয়া আলোচনা করিতেছিল, তখন ভোলানাথ মুরুব্বির মতো গম্ভীর হইয়া বলিল, “ওয়েবস্টারের ডিকশনারি সবচাইতে ভালো। আমার বড়্‌ দাদা যে দু-ভলুম। ওয়েবস্টারের ডিকশনারি কিনেছেন, তার এক-একখানা বই এ-ত্তোখানি বড়ো আর এ-ম্-নি মোটা! আর লাল চামড়া দিয়ে বাঁধানো!” উঁচু ক্লাশের একজন ছাত্র আচ্ছা করিয়া তাহার কান মলিয়া বলিল, “কিরকম লাল হে? তোমার এই কানের মতো?” কিন্তু তবু, ভোলানাথ এমন বেহায়া, সে তার পরদিনই সেই তাহাদেরই কাছে ফুটবল সম্বন্ধে কি যেন মতামত দিতে গিয়া এক চড় খাইয়া আসিল।

 বিশুদের একটা ইঁদুর ধরিবার কল ছিল। ভোলানাথ হঠাৎ একদিন, “এটা কিসের কল ভাই” বলিয়া খামখা সেটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া কলকব্‌জা এমন বিগড়াইয়া দিল যে কলটা একেবারেই নষ্ট হইয়া গেল। বিশু বলিল, “না জেনেশুনে কেন টানাটানি করতে গেলি?” ভোলানাথ কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হইয়া বলিল, “আমার দোষ হল বুঝি? দেখ তো, হাতলটা কিরকম বিচ্ছিরি বানিয়েছে। ওটা আরো অনেক মজবুত করা উচিত ছিল। কলওয়ালা ভয়ানক ঠকিয়েছে।”

 ভোলানাথ পড়াশুনায় যে খুব ভালো ছিল তাহা নয়, কিন্তু তবু, মাস্টারমহাশয় যখন কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন, তখন সে জানুক আর না জানুক, সাততাড়াতাড়ি সকলের আগে জবাব দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিত। জবাবটা অনেক সময়েই বোকার মতো হইত, শুনিয়া মাস্টারমহাশয় ঠাট্টা করিতেন, ছেলেরা হাসিত, কিন্তু ভোলানাথের উৎসাহ তাহাতে কমিত না।

 সেই যেবারে ইস্কুলে বই চুরির হাঙ্গামা হয় সেবারও সে এইরকম সর্দারি করিতে গিয়া খুব জব্দ হয়। হেডমাস্টার মহাশয় ক্রমাগত বই চুরির নালিশে বিরক্ত হইয়া একদিন প্রত্যেক ক্লাশে ক্লাশে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে চুরি করিতেছে তোমরা কেউ কিছু জান?” ভোলানাথের ক্লাশে এই প্রশ্ন করিবামাত্র ভোলানাথ তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, “আতে, আমার বোধ হয় হরিদাস চুরি করে!” জবাব শুনিয়া আমরা সবাই অবাক হইয়া গেলাম, হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কি করে জানলে যে হরিদাস চুরি করে?” ভোলানাথ অম্লাবদনে বলিল, না, জানি নে-কিন্তু আমার মনে হয়।” মাস্টারমহাশয় ধমক দিয়া বলিলেন, “জান না, তবে অমন কথা বললে কেন? ওরকম মনে করবার তোমার কি কারণ আছে।”

ইস্কুলের গল্প
১৩৫