পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বন্ধু পাঁচকড়িকে বলল, “দেখেছিস, পাঁচু, আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আবার ঘুড়ি কেনা হচ্ছে! এ-সব কিন্তু নেহাত বাড়াবাড়ি। নাহয় দুটো ঘুড়িই কেটেছিস বাপু, তার জন্যে এত কি গিরিম্বাড়ি!” এই বলে সে পাঁচুর কাছে তার মাঞ্জা তৈরির মতলবটা খুলে বলল। শুনে পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, “তা যদি বলিস, তুই আর মাঞ্জা তৈরি করে ওদের সঙ্গে পারবি ভেবেছিস? ওরা হল ডাক্তারের ছেলে, নানারকম ওষুধমসলা জানে। এই তো সেদিন ওর দাদাকে দেখলাম, শানের ওপর কি একটা আরক ঢেলে দিল আর ভস্‌ভস্ করে গ্যাঁজালের মতো তেজ বেরতে লাগল। ওরা যদি মাঞ্জা বানায়, তা হলে কারও মাঞ্জার সাধ্যি নেই যে তার সঙ্গে পেরে ওঠে!” শুনে ব্যোমকেশের মনটা কেমন দমে গেল। তার ধ্রুবরকম বিশ্বাস হল যে ডাক্তারের ছেলেটা নিশ্চয় কোনো আশ্চর্যরকম মাঞ্জার খবর জানে। তা নইলে ব্যোমকেশের চাইতেও চারবছরের ছোটো হয়ে সে কেমন করে তার ঘুড়ি কাটল? ব্যোমকেশ স্থির করল, যেমন করে হোক ওদের বাড়ির মাঞ্জা খানিকটা জোগাড় করতেই হবে। সেটা একবার আদায় করতে পারলে তার পর সে ডাক্তারের ছেলেকে দেখে নেবে।

 বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি জলখাবার সেরে নিয়েই ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল ডাক্তারবাবুর ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করতে। সেখানে গিয়ে সে দেখে কি, কোণের বারান্দায় বসে, সেই ছোট্টো ছেলেটা একটা ডাক্তারি খলের মধ্যে কি যেন মসলা ঘুঁটছে। ব্যোমকেশকে দেখেই সে একটা চৌকির তলায় সব লুকিয়ে ফেলে সেখান থেকে সরে পড়ল। ব্যোমকেশ মনে মনে বলল, ‘বাপু হে। এখন আর লুকিয়ে করবে কি? তোমার আসল খবর আমি টের পেয়েছি’ এই বলে সে এদিক-ওদিকে তাকিয়ে দেখল, কোথাও কেউ নেই। একবার সে ভাবল, কেউ আসলে এর একটুখানি চেয়ে নেব। আবার মনে হল, কি জানি, চাইলে যদি না দেয়? তার পর ভাবল, দূর। ভারি তো জিনিস তা আবার চাইবার দরকার কি? এই এতটুকু মাঞ্জা হলেই প্রায় দুশোগজ সুতোয় শান দেওয়া হবে। ভেবে সে চৌকির তলা থেকে এক খাবল মসলা তুলে নিয়েই এক দৌড়ে বাড়ি এসে হাজির। আর কি তখন দেরি সয়? দেখতে দেখতে দক্ষিণের বারান্দা জুড়ে সুতো খাটিয়ে মহা উৎসাহে তার মাঞ্জা দেওয়া শুরু হল। যাই বল, মাঞ্জাটা কিন্তু ভারি অদ্ভুত-কই, তেমন কড়্‌কড়্ করছে না তো। বোধ হয় খুব মিহি গুঁড়োর তৈরি-আর কালো কাঁচের গুঁড়ো। দুঃখের বিষয়, বেচারার কাজটা শেষ না হতেই সন্ধে হয়ে এল, আর তার বড়দা এসে বললে, “যা, যা! আর সুতো পাকাতে হবে না, এখন পড়গে যা।”

 সে রাত্তিরে ব্যোমকেশের ভালো করে ঘুমই হল না। সে স্বপ্ন দেখল যে, ডাক্তারের ছেলেটা হিংসে করে তার চমৎকার সুতোয় জল ফেলে সব নষ্ট করে দিয়েছে। সকাল হতে না হতেই ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল তার সুতোর খবর নিতে। কিন্তু গিয়েই দেখে কে এক বুড়ো ভদ্রলোক ঠিক বারান্দার দরজার সামনে বসে তার দাদার সঙ্গে গল্প করছেন, তামাক খাচ্ছেন। ব্যোমকেশ ভাবল “দেখ তো কি অন্যায়। এর মধ্যে থেকে এখন সুতোটা আনি কেমন করে? যা হোক, খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সে খুব সাহসের সঙ্গে গিয়ে চট করে তার সুতো খুলে নিয়ে চলে আসছে—এমন সময়ে, হঠাৎ কাশতে গিয়ে বুড়ো লোকটির

ইস্কুলের গল্প
১৩৯