পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না। চাষারা নিশ্চিন্তে চাষ করিত, লোকে স্বছন্দে চলা-ফিরা করিত, কাহারও মমে হয় নাই যে এই মাটি খুঁড়িলেই প্রকাণ্ড শহর বাহির হইয়া পড়িবে। তার পর, সে প্রায় একশত বৎসরের কথা, সেই মাটির নীচ হইতে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব জিনিস বাহির হইতে লাগিল। বাড়ির টুকরা, পাথরের বেদী, বাঁধানো রাস্তা এই-সকল দেখিয়া তখন লোকের মনে পড়িল দুহাজার বৎসর আগে এইখানে প্রকাণ্ড শহর ছিল।

 পম্পেয়াই বড়ো যেমন-তেমন শহর ছিল না সেকালের ইতিহাসে লেখে, তিনলক্ষ লোক সে শহরে বাস করিত। জায়গাটা সমুদ্রের ধারে আর খুব স্বাস্থ্যকর, তাই বড়োবড়ো রোমান ধনীরা অনেকে সেখানে থাকিতেন। খুব জমকাল শহর বলিয়া সে সময় পম্পেয়াই-এর খুব নাম ছিল। তাহার বাড়িঘর, পথঘাট, বাগান, সাজসজ্জা বড়োলোকের শহরেরই মতো ছিল। ভিসুভিয়াসের যে কোনোরকম দুষ্ট মতলব আছে তাহা কেহ তখন জানিত না তাই একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁষিয়া শহর বসানো হইয়াছিল।

 শহর ধ্বংস হয় ৭৯ খৃস্টাব্দে। তখন রোমান ধনীরা তাঁহাদের সুন্দর শহরকে সুন্দর করিয়া সাজাইয়া আরামে আলস্যে দিন কাটাইতেছেন- পম্পেই শহর বাবুয়ানায় মত্ত। কোনো বিপদের চিহ্ন নাই, তখন বলিতে গেলে পৃথিবীময় রোমান রাজ্য—রোমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, রোমানদের সঙ্গে শত্রুতা করে কার সাধ্য! লোকে নিশ্চিন্ত আছে কোথাও ভয় নাই। মাঝে মাঝে একটু-আধটু ভূমিকম্প হইত, পাহাড়ের ভিতরে গুরগুর, শব্দ শোনা যাইত, কিন্তু তাহাতেও লোকের বিশেষ কোনো ভয় নাই। কিছুদিন দেখিয়া শুনিয়া সকলেরই সে-সব অভ্যাস হইয়া গেল। তার পর একদিন হঠাৎ পাহাড়ের চূড়া ভাঙিয়া কালো ধোঁয়া দমকা হাওয়ার মতো চারিদিকে ছুটিয়া বাহির হইল। সেই ধোঁয়ায় পঞ্চাশ মাইল পথ এমন অন্ধকার হইয়া গেল যে মাটি আর আকাশ তফাত করা যায় না। তার পরে খানিকক্ষণ গরম ধুলার তুফান চলিল। ইহার মধ্যে যাহারা শহর ছাড়িয়া পলাইয়াছিল তাহাদের অনেকে বাঁচিতে পারিয়াছিল। কিন্তু শহরের মধ্যে একজন লোকও বঁচে নাই। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ চমকাইতে লাগিল, ক্রমাগত ভয়ানক বাজ পড়িতে লাগিল। ভূমিকম্প আরম্ভ হইল, বাড়িঘর ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে লাগিল, ভিসুভিয়াস সমদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলিয়া ফুলিয়া শেষটায় ভয়ানক শব্দে ফাটিয়া গেল। পাহাড়ের ভিতর হইতে লক্ষ লক্ষ মণ জ্বলন্ত পাথর ছিটকাইয়া চারিদিকে আগুন বৃষ্টি করিতে লাগিল। ইহার পরেও হয়তো অনেক লোক বাঁচিতে পারিত কিন্তু এখানেই বিপদের শেষ হইল না। ভিসুভিয়াসের ভিতরকার পাথর গরমে গলিয়া ভাঙা পাহাড়ের ফাটল দিয়া শহরের উপর গড়াইয়া পড়িল, সমস্ত শহরটা যেন টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল। অনেকে আগুনের ভয়ে সমুদ্রের দিকে পলাইয়াছিল কিন্তু সেখানেও রক্ষা নাই। এই প্রলয় কাণ্ডের মধ্যে সমুদ্র কি স্থির থাকিতে পারে? সে প্রথমটা তীর হইতে পিছাইয়া গেল। দেখিয়া বোধ হইল যেন সমুদ্র আগুনের ভয়ে হটিয়া যাইতেছে। সমুদ্রের জন্তুগুলি শুকনা ডাঙায় পড়িয়া কত যে মারা গেল তাহার ঠিক নাই। কিন্তু সমুদ্র যাইবে কোথায়? একটু পরেই ভূমিকম্পের একটা ধাক্কার সঙ্গে সে আবার আসিয়া পড়িল, এবং নৌকা ঘরবাড়ি পথঘাট যাহা ছিল সমস্ত ভাঙিয়া ভাসাইয়া প্রমাণ করিয়া দিল যে, “আমিও বড়ো কম

নানা নিবন্ধ
১৫৩