পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কাপড়ের কথা

 ঐ যে জামাটা তুমি গায়ে দিয়েছ, ওর কাপড়টা তৈরি করতে কত লোককে কত হাঙ্গাম করতে হয়েছে, তুমি কি একবার ভেবে দেখেছ? তুলার ক্ষেতে যখন তুলা হল, তখন কত লোকে এসে সেই-সব তুলা গাছ থেকে তুলে নিয়ে এক জায়গায় জড় করল। কলে সেই তুলার বীচি পরিষ্কার করে তাকে গাঁটে বেঁধে ফেলল। তার পর সেই তুলা কত দেশবিদেশে ঘুরে, কাপড়ের কলে এসে হাজির হল।

 আমি একদিন একটা কাপড়ের কল দেখতে গিয়েছিলাম। সেটা খুব বড়ো কম নয়। তার চেয়ে অনেক বড়ো কল আমাদের দেশে আছে। কিন্তু তারই সব কাণ্ডকারখানা দেখলে অবাক হয়ে থাকতে হয়। প্রকাণ্ড এক তিনতলা বাড়ির ছাদে অনায়াসে একটা ফুটবল খেলার জায়গা হতে পারে। প্রথমেই গেলাম তিনতলায়। সেখানে একটা প্রকাণ্ড বাষ্পে-চালানো কপিকল আছে; তলার চালান এলে প্রথমেই গীটগুলি কপিকলে করে তিনতলায় তোলা হয়। তার পর গাঁট খুলে তুলা কলে পরিষ্কার করা হয়। সেই কলে তুলাকে ঝেড়ে আছড়িয়ে দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে ধুলা, বালি, বীচি, খড়, কুটো সমস্ত বার করে ফেলে, তার পর সেই পরিষ্কার তুলায় চাপ দিয়ে আর একটা কলে মোটা মোটা লেপের মতন তৈরি হয়। সেই ‘লেপ'গুলি তার পর দোতলায় চালান করে। সেখানে সেই লেপ থেকে সুতা কাটা হয়। সে এক বিরাট ব্যাপার। প্রথমে অনেকগুলো কলে সেই। থেকে জাহাজ বাঁধা দড়ির মতো মোটা দড়ি তৈরি হয়। তার পর আর-একটা কলে সেই দড়ি থেকে টেনে মোটা সুতা বার করা হয়। এমনি করে কলের পর কল-তাতে সুতা ক্রমেই খুব সরু হয়ে আসে। এ ঘরের কল-কারখানা বড়োই অদ্ভুত। চারিদিকে প্রকাণ্ড লম্বা-লম্বা কল সারি সারি সাজানো, তার প্রত্যেকটাতে হাজার হাজার লম্বা 'নলি’ (সূতা পাকাবার জন্য ছোটো ছোটো কাঠের ‘লাটাই’) বন্‌বন্ করে ঘুরছে আর সুতা পাকানো হচ্ছে। তা ছাড়া কলকবজা যে কতরকম চলছে তার আর কথাই নাই। দেখলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়, কিন্তু কারখানার কোথাও একটু গোলমাল দেখতে পাবে না। যে যার কাজ করছে আর সব কল ঠিক চলছে। সূতা কাটা হয়ে গেলে, তৈরি সূতার 'নলি'গুলো আর-একটা কলের কাছে নিয়ে যায়। এটা হচ্ছে কাপড়ের টানা দেবার কল। টানা কাকে বলে জান? কাপড়ে লম্বালম্বিভাবে যে-সূতা থাকে তাকে ‘টানা' বলে, আর চওড়াভাবে যে সুতা থাকে তাকে ‘পড়েন' বলে। এই টানা দেবার কল বড়ো আশ্চর্য। হাজার হাজার নলি থেকে সূতা টেনে একটা চিরুনির মতো জিনিসের ভিতর দিয়ে গলিয়ে নিয়ে একটা রোলারে জড়ায়। কল চলতে চলতে যদি একটাও সূতা ছিড়ে যায়, অমনি আপনি-আপনি ‘ঢং' করে ঘটা বেজে ওঠে আর কল থেমে যায় সুতাটা জোড়া দিলে তবে কল চলবে। একসঙ্গে অনেক থান কাপড়ের টানা দেওয়া হয়ে থাকে। টানার সূতায় রোলার ভর্তি হয়ে গেলে সেই রোলারটাকে একতলায় চালান করা হয়। সেখানে কলে সুতায় মাড় দেওয়া হয়।

নানা নিবন্ধ
১৬৫