পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শিলিং (নয় টাকা) মাইনে হল—তার উপর জুতা সেলাই করে আর ঘড়ি মেরামত করেও সে কিছু কিছু উপার্জন করতে লাগল। সকলে বলল, “জর্জ মস্ত রোজগেরে হয়েছে।” এইভাবে প্রায় ত্রিশ বৎসর কেটে গেল, এর মধ্যেই পাকা এঞ্জিনিয়ার বলে স্টিফেনসনের বেশ একটু নাম হয়েছে।

 ১৮১৪ খৃস্টাব্দে তেত্রিশ বৎসর বয়সে এক খনির মালিককে রাজি করিয়ে স্টিফেনসন তার প্রথম চলন্ত এঞ্জিনের পরীক্ষা করেন। এই এঞ্জিনের সঙ্গে কয়লার গাড়ি জুড়ে দেখা গেল যে পাঁচশত মণ কয়লা উঁচু রাস্তায় ঘণ্টায় চার মাইল করে নেওয়া যায়। আগে ট্রামের লাইন বসিয়ে তার উপর লোকেরা গাড়ি ঠেলে নিত, সেই লাইনের উপরই এঞ্জিন বসিয়ে কয়লা চালানো হতে লাগল। তার পর বছরখানেকের মধ্যে আরো ভালো দুটি এঞ্জিন তৈয়ারি হল। ক্রমে আশেপাশে আরো কত কয়লার খনিতে স্টিফেনসনের এঞ্জিন চলতে লাগল। এমনি করে আট-দশ বৎসর কেটে গেল।

 তখন স্টকটন হতে ডার্লিংটন পর্যন্ত কয়েক মাইল ট্রামের লাইন বসিয়ে ঘোড়ার ট্রাম করবার কথা হচ্ছিল। স্টিফেনসন প্রস্তাব করলেন, ঐ লাইনের উপর এঞ্জিনের গাড়ি চালানো হোক। অনেক কথাবার্তা হাঁটাহাঁটির পর, ট্রামের কর্তারা রাজি হলেন। ১৮২৫ খৃস্টাব্দে এই লাইন যেদিন খোলা হল তখন ‘ষ্টিফেনসনের লোহার ঘোড়া' দেখবার জন্য ভিড় জমে গিয়েছিল। কয়লা আর ময়দায় বোঝাই হয়ে একগাড়ি যাত্রী নিয়ে স্টিফেনসনের এঞ্জিন স্টকটন হতে রওয়ানা হল; স্টিফেনসন নিজে তার ড্রাইভার। গাড়ির আগে আগে কোম্পানির লোক ঘোড়ায় চড়ে নিশান নিয়ে ছুটল। কিন্তু ষ্টিফেনসন তাঁর এঞ্জিনে পুরো দম দিয়ে এমন ছুটিয়ে দিলেন যে, সে লোকটির আর সঙ্গে যাওয়া হল না। ডার্লিংটনে সমস্ত মালপত্র নামিয়ে সমস্ত ট্রেনটিকে পঙ্গপালের মতো লোক-বোঝাই করে স্টিফেনসন স্টকটনে ফিরে এলেন। না জানি সে সময়ে লোকের মনে কিরকম উৎসাহ হয়েছিল।

 কিন্তু এতেও গোলমাল মিটল না। এর পর যখন মানচেস্টার থেকে লিভারপুল পর্যন্ত রেল করবার কথা হল, তখন আবার তুমুল ঝগড়া আরম্ভ হল। রেলগাড়ি জিনিসটাতেই অনেকের আপত্তি। কেউ কেউ তাকে ‘শয়তানের যন্ত্র' বলে গাল দিতেও ছাড়ে নি। এর মধ্যে আবার অন্য কয়েকটি এঞ্জিনওয়ালা এসে বললেন, “আমরা আরো ভালো এঞ্জিন বানিয়েছি—আমাদের উপর ভার দাও।” কেউ বললেন, “ষ্টিফেনসন আবার কোথাকার। কে? নাম জানি না, ধাম জানি না—এত বড়ো কাজের ভার কি যার তার উপর দেওয়া যায়?” তখন চারিদিক থেকে পার্লামেণ্টের কাছে দরখাস্ত যেতে লাগল। পার্লামেণ্টের হকুমে সব এঞ্জিন এক জায়গায় আনিয়ে তার পরীক্ষা নেয়া হল। পরীক্ষায় স্টিফেনসনের এঞ্জিন অর সবকটাকে একেবারে পিছনে ফেলে ঘণ্টায় ত্রিশ মাইল ছুটে সকলের মনে এমন তাক লাগিয়ে দিল যে, যারা ঝগড়া করতে এসেছিল তাদের আর কথাটি কইবার মুখ রইল না। এঞ্জিনওয়ালারা তাদের এঞ্জিনের ঝ্যাঁক্‌-ঝ্যাঁকানি বন্ধ করে লজ্জায় বাড়ি চলে গেল।

 এমনি করে ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে রীতিমতো রেলের চলাচল আরম্ভ হল। তার পর কত

নানা নিবন্ধ
১৬৯