পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে; এবং তার ফলে এটুকু বোঝা গেছে যে, জাহাজ যেমন করে জল কেটে এগিয়ে চলে তেমনি করে যদি বাতাস কেটে ঘুড়িকে ঠেলে নেওয়া যায়, তবে হয়তো তাকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে চালানো যেতে পারে। এই চেষ্টার ফলে যে জিনিস দাঁড়িয়েছে তারই নাম এরোপ্লেন।

 এরোপ্লেনের চেহারা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলবার দরকার নাই, কারণ, তার ছবি তোমরা অনেক দেখেছ। কিন্তু সেটা যে একটা ঘুড়িমাত্র এ কথাটা তার পাখির মতো চেহারা দেখে সব সময়ে মনে আসে না। কিন্তু বাস্তবিক সেটা ঘুড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘুড়িকে ওড়াতে হলে যেমন সুতো ধরে টানা দরকার, এরোপ্লেনকে ঠিক তেমনি বাতাস ঠেলে কলের জোরে টানতে হয়। সুতরাং ঘুড়িতে যতরকম বদভ্যাস আর কেরামতি দেখা যায়, এরোপ্লেনেও প্রায় সেইরকম। ঘুড়ির মতো সেও বেখাপ্পা ‘গোঁৎ' খেতে চায়, হঠাৎ শূন্যের মাঝে কাত হয়ে পড়তে চায়, আর এলোমেলো বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে উলটাতে চায়। এতরকম তাল সামলে তবে এরোপ্লেন চালানো শিখতে হয়। ঘুড়িতে যদি বেখাপ্পা জোরে হ্যাঁচকা টান দেও তবে সে যেমন ফস্ করে ফেঁসে যেতে পারে, এরোপ্লেনও তেমনি ডানা ভেঙে ধপ্ করে পড়ে যাওয়া কিছু বিচিত্র নয়। যারা এ বিষয়ে ওস্তাদ, তাদের কাছে এরোপ্লেনের এ-সব পাগলামি নিতান্তই সামান্য ব্যাপার। তারা ইচ্ছা করেই কত সময় এরোপ্লেন সুদ্ধ শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে তামাশা দেখায়, এরোপ্লেনকে নানারকমে গোঁৎ খাওয়ায়।

 ঘুড়ি আর ফানুষে যে তফাত, 'এরোপ্লেন’ আর ‘এয়ারশিপ’ বা আকাশ-জাহাজে ঠিক সেই তফাত। ফানুষকে অর্থাৎ বেলুনকে ইচ্ছামতো এদিক-ওদিক চালাবার চেষ্টাতেই আকাশ-জাহাজের সৃষ্টি। গোল বেলুন বাতাসের উলটোমুখে চলতে গেলে চ্যাপ্টা হয়ে যায়, তাই তাকে চমচমের মতো ছুঁচাল করে বানায়-তা হলে সে সহজেই বাতাস ফুঁড়ে এগতে পারে। তার পিছনে হাল ও আশেপাশে মাছের ডানার মতো থাকে—তা দিয়ে জাহাজকে ইচ্ছামতো ডাইনে বাঁয়ে উপর নীচে চালানো যায়। আর থাকে বিদ্যুতের পাখার মতো মস্ত একটা ঘুরন্ত জিনিস, সেইটার ধাক্কায় বাতাস ঠেলে জাহাজ চলে। এরোপ্লেনেও অবশ্য ঠিক এইরকম পাখা থাকে।

 এই যুদ্ধের সময়ে এরোপ্লেন আর এয়ারশিপগুলি কিরকম কাজে লেগেছে তার সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলি। এরোপ্লেনগুলো চলে ব্যস্তবাগীশের মতো ফর্‌ফর্ করে, তারা দিনদুপরে যখন তখন যেখানে সেখানে উড়ে যায় আর নানারকম খবর আনে। দরকার হলে ধাঁ করে শত্রুর শিবিরে বা গোলা-বারুদের গুদামে বা অস্ত্রের কারখানায় দু-দশটা বোমা ফেলে আসে, অথবা বন্দুক দিয়ে শত্রুর এরোপ্লেন বা জাহাজ আক্রমণ করে। এ-সব ছোটোখাটো কাজে এরোপ্লেনেই সুবিধা বেশি। দশ বছর আগে বিলাতের লোকেও এরোপ্লেন জিনিসটাকে একটা আশ্চর্য তামাশার ব্যাপার মনে করত, অথচ এখন এই যুদ্ধে কত হাজার হাজার এরোপ্লেন ঘোরাফিরা করে-কে তার খবর রাখে?

 আকাশ-জাহাজগুলো প্রকাণ্ড গম্ভীর জিনিস, একেবারে কুড়ি-ত্রিশ মণ বোমা নিয়ে ফেরে। তার উপর কামান বন্দুকও সঙ্গে থাকে। তারা আসে যায় অন্ধকার রাত্রে চোরের মতো-

১৮৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২