পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ কথাটা অনেক দেশের অনেক পুরাণেই শোনা যায় যে, একবার প্রলয় হয়ে এই পৃথিবীটা ডুবে গেছিল। তাতে সমস্ত জীবজন্তু প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পণ্ডিতেরা বলেন, এ কথাটার মধ্যে একটুখানি সত্যিকারের ইতিহাস আছে। যারা ভূতত্ত্ববিদ অর্থাৎ যাঁরা পাথর পাহাড় ঘেঁটেঘুটে পৃথিবীর পুরানো কথার সংবাদ নিয়ে ফেরেন তাঁরা বলেন যে মানুষের জীবনে বড়ো-বড়ো রোগের মতো পৃথিবীর জীবনেও এক-একটা বড়ো-বড়ো ‘সংকট যুগ’ দেখা গিয়েছে। যুগে যুগে বড়ো-বড়ো দেশের জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে, গ্রীষ্মের দেশ হিমেল হাওয়ায় বরফে ঢেকে গিয়েছে, আর দুরন্ত শীতের দেশে বরফ ঠেলে সবুজ ঘাস আর বনজঙ্গল দেখা দিয়েছে। যেখানে দেশ ছিল সেখানে কত সাগর হয়েছে—আবার, কত কত সাগর ফুঁড়ে নতুন দেশ মাথা তুলেছে। আর, মাঝে মাঝে এক-একটা বন্যা এসে পাহাড় ধুয়ে পৃথিবী ধুয়ে দেশকে দেশ সাফ করে দিয়েছে। এইরকম ছোটো বড়ো কত প্রলয় এই পৃথিবীর উপর দিয়ে চলে গিয়েছে—আমরা এখনো পুরাণের মধ্যে, গল্পের মধ্যে তারই একটু আভাস পাই, আর পাহাড়ে পর্বতে পাথরের স্তরে তার নানারকম পরিচয় দেখি।

 একজন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, “এই যে সূর্য এ চিরকাল এমন থাকবে না। একদিন এরও তেজ ফুরিয়ে যাবে-এ-ও তখন নিভে যাবে।” এই কথা শুনে একজন ভীতু-গোছের ভদ্রলোক তাঁকে চিঠি লেখেন যে, “মহাশয়, আপনি যেরকম বিপদের কথা বললেন তা শুনে আমার বড়ো ভয় হয়েছে। সেরকম প্রলয়টা কবে হবে, আর আমার ছেলেপিলেদের জন্য তা হলে কিরকম ব্যবস্থা করলে তারা বাঁচতে পারে—আমায় একটু জানাবেন কি?” জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত তার উত্তরে লিখলেন, “আপনার এত ব্যস্ত হবার কোনো কারণ নেই—আপনার ছেলেরা যদি লাখ বছরও বেঁচে থাকে, তব এ সূর্যকে আজ যেমন দেখছে তখনো তেমনই দেখবে-তেজ ফুরাতে আরো অনেক দেরি আছে। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। লোকে বড়ো-বড়ো ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প আগুনের উৎপতি দেখে তা থেকে প্রলয় জিনিসটা কি রকম, তার একটা আন্দাজ করে। বাস্তবিক, ছোটোখাটো প্রলয় পৃথিবীর উপর দিয়ে সব সময়েই চলেছে। কিন্তু আজ যে প্রলয়ের কথা বলব সেটা কিন্তু সত্যিকার প্রলয় নয়—লোকে প্রলয়ের হজুকে যে নানারকম মিথ্যা ভয়ের সৃষ্টি করে, তারই কথা।

 অপরিচিত জিনিস দেখলেই তার সম্বন্ধে মানুষের ভয় বিস্ময় বা কৌতুহল জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। যে জিনিস সর্বদাই দেখতে পায় তাতে মন এমন অভ্যস্ত হয়ে যায় যে সেটাতে আর কোনোরকম আশ্চর্য বোধ হয় না। মনে কর, এই সূর্য যদি প্রতিদিন না উঠে হঠাৎ এক-একদিন ঐরকম ভয়ানক আগুনের মতো মুর্তি নিয়ে হাজির হত, তা হলে অধিকাংশ লোকেই যে একটা প্রলয়কাণ্ড হবে মনে করে ভয়ে অস্থির হত তা বুঝতেই পার। চাঁদকেও যদি দু-দশ বছরে কৃচিৎ এক-আধবার দেখা যেত তবে লোকে না জানি কত আগ্রহ করে কত আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখত, আর না জানি সেটা আমাদের চোখে কি সুন্দর লাগত।

 ধূমকেতুগুলো যদি মাঝে মাঝে এক-আধটা না এসে ঐ চন্দ্র সূর্যেরই মতো নিতান্ত সাধারণ জিনিস হত, তবে তাদের ঐ ঝাপসা ঝাঁটার মতো চেহারা দেখে ভয় পাবার

নানা নিবন্ধ
১৯১