পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যেখানে আকাশের খোলা ময়দান পড়িয়া আছে সেখানে যাও; দেখিবে, যে নিয়মে প্রহ চন্দ্র সকলে আপন আপন পথে ঘুরিতেহে সেই একই নিয়মে অতি ক্ষুদ্র ধূলিকণাও আকাশপথে বড়ো-বড়ো চক্র আঁকিয়া চলিতেছে। এই প্রকাণ্ড পৃথিবী যদি একটি ধূলিকণার মতোই হইত, তবুও সে এমনিভাবে বছরের পর বছর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিয়া ফিরিত-কে তখন তাহার খবর রাখিত?

 এই পৃথিবীর উপর ধুলার যে অদ্ভুত খেলা চলিয়াছে তাহাকে ধুলার খেলা বলিয়া জানে কয়জন? যখন কণায় কণায় বৃষ্টিজল জমিয়া বর্ষাধারা নামিতে থাকে, যখন কুয়াশার ঘনঘটায় চারিদিক ঢাকিয়া ফেলে তখন নিশ্চয় জানিয়ো এ-সমস্তই ধুলার কৃপায়। ধুলা না থাকিলে বাষ্পকণা জমিয়া জল হয় না, স্বচ্ছ আকাশে মেঘ কুয়াশার জন্ম হয় না।

 সুতরাং ধুলা জিনিসটাকে আমরা যতই অকাজের জিনিস বলিয়া উড়াইয়া দেই-না কেন, উৎপাত মনে করিয়া তাহাকে যতই দূর করিতে চাই-না কেন, আর তাহার পরিচয় লওয়াটা যতই অনাবশ্যক ভাবি-না কেন, আসলে সে বড়ো একটা সামান্য জিনিস নয়। তোমরা হয়তো বলিবে, ‘সামান্য না হউক, জিনিসটা বড়ো বিশ্রী ও নোংরা। হাঁ, নোংরা বটে। যখন সে আমার সাফ কাপড় ময়লা করিয়া দেয়, আবার ঘরের মধ্যে যেখানে সেখানে জমিয়া থাকে, যেখানে তাহাকে দিয়া আমার কোনো দরকার নাই সেইখানে আসিয়া পড়ে—তখন তাহাকে নোংরা বলি। কিন্তু ধুলা বলিলেই যে একটা নোংরা বিশ্রী কিছু ভাবিতে হইবে, এরূপ মনে করা ঠিক নয়। প্রজাপতির পালক ঝাড়িলে যে ধুলা পড়ে তাহা চোখে দেখিতে অতি সুক্ষ্ম একটুখানি হালকা গুঁড়ার মতো দেখায়—দেখিলে কেহই তাহাকে ধুলা ছাড়া আর কিছুই বলিবে না। কিন্তু অণুবীক্ষণ দিয়া তাহাকে এমনই সুন্দর দেখায়! বাতাসে যে-সকল ধূলিকণা ভাসিয়া বেড়ায় তাহার মধ্যেও কত সময়ে কত আশ্চর্যরকমের কারিকুরি দেখা যায়।

 গভীর সমুদ্রের তলা হইতে পাঁক ঘাঁটিয়া বা পচা পুকুরের উপরকার ময়লা ছাঁকিয়া যে জীবন্ত ধূলি বাহির হয় তাহার মতো সুন্দর জিনিস খুব অল্পই আছে। এগুলিকে উদ্ভিদ বলিতে পার, কিন্তু উদ্ভিদ বলিতে সাধারণত যেরকম জিনিস মনে করিয়া বসি, এগুলি একেবারেই সেরূপ নয়। ইংরাজিতে ইহাদিগকে ডায়াটম্ (Diatom) বলে— আমরা এখানে তাহাকেই জীবন্ত ধূলি বলিতেছি। তাহাদের কতরকম চেহারা, তাহার উপর কতরকম কারিকুরি। এই 'Diatom' কথাটি, ইহার ০ অক্ষরটির মধ্যে যেটুকু ধরে তাহার চাইতেও কম পরিমাণ ধূলিকে অণুবীক্ষণের সাহায্যে ফোটো তুলিয়া দেখিতে পার। তাহার চাইতেও ছোটো ‘ডায়াটম’ অসংখ্য প্রকারের আছে। জলের উপর শেওলার মতো এই অদ্ভুত জিনিসগুলা কত সময়ে ভাসিতে থাকে। সাধারণ লোকে তাহাকে নোংরা ও বিশ্রী বলিয়া এড়াইয়া চলে, তাহার ভিতরে যে কি আশ্চর্য সুক্ষ কাজ তাহারা সে সংবাদ রাখে না। কিন্তু যাঁহারা এ-সকলের চর্চা করেন তাঁহারা যত্ন করিয়া এই ময়লা ঘাঁটিয়া এই-সব উদ্ভিদ সংগ্রহ করেন ও তাহাদের চালচলন আকার-প্রকার লক্ষ্য করিয়া তাহাদের জীবন সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা আমাদের শুনাইয়া থাকেন। ডায়াটমগুলিকে পোড়াইয়া

১৯৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২