পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র এদের আলো কেমন স্থির। তারাগুলো অনেক সময়ে মিট্‌মিট্ করে বটে, কিন্তু এলোমেলোভাবে কেউ নড়েচড়ে বেড়ায় না। কিন্তু ‘আকাশ আলেয়া' বাস্তবিক ঐ সুদূর আকাশের জিনিস নয়, তার জন্মস্থান এই পৃথিবীর বাতাসেরই চূড়ার উপরে। বাতাস সেখানে অসম্ভবরকম হালকা, তার উপরে সূর্যের বিদ্যুৎকিরণ পড়ে তাকে চঞ্চল করে ‘আকাশ আলেয়া'র সৃষ্টি করে-সুতরাং ‘আকাশ আলেয়ার' চালচলনটাও কিছু অস্থিররকমের। কিন্তু অস্থির বলতে একেবারে বিদ্যুতের মতো দুরন্ত একটা কিছু মনে কোরো না। তার অস্থিরতা শ্রাবণের তুফান হাওয়ার মতো নয়, বসন্তের ঝিরঝিরে বাতাসের মতো।

 ‘আকাশ আলেয়া’র রঙ রামধনুর চাইতেও সুন্দর, কারণ সেটা সত্যিকার অলোকশিখা; আলোকটা তার নিজেরই আলো—আর রামধনুর আলো সূর্যের আলোর ধার-করা ছায়া মাত্র। তা ছাড়া অন্ধকার আকাশের কালো জমির উপরে রঙের খেলা যেমন খেলে, দিনেরবেলায় মেঘের গায়ে তেমন করে খুলতেই পারে না। অতি সুন্দর অতি স্নিগ্ধ হালকা নীল লাল সবুজ রঙের শিখার মতো এই আলো আকাশ জুড়ে খেলা করে। কখনো উপরে ওঠে, কখনো নীচে নামে, কখনো মিনিটে মিনিটে বহুরূপীর মতো রঙ বদলায়, কখনো রঙিন পর্দার মতো দুলতে থাকে, কখনো ঘূর্ণার পাকের মতো ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে, কখনো ধূমকেতুর ল্যাজের মতো আকাশের গায়ে খাড়া থাকে, আবার কখনো আলগা হয়ে টুকরো হয়ে আকাশময় ছড়িয়ে পড়ে। এক-এক সময়, বিশেষত শীতের রাতে এই আলোর খেলা এমন সুন্দর হয় যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার তামাশা দেখেও ক্লান্তিবোধ হয় না।

 এই পৃথিবীটা একটা প্রকাণ্ড চুম্বকের গোলা—সেই চুম্বকের এক মাথা উত্তরে আর এক মাথা দক্ষিণে, মেরুর কাছে। আর সূর্যটা যেন একটা প্রকাণ্ড বিদ্যুৎশক্তির কুণ্ড তার মধ্যে থেকে নানারকম আলো আর বিদ্যুতের তেজ আকাশের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তার খানিকটা আমরা দেখি, আর অনেকটাই হয়তো দেখি না। পণ্ডিতেরা বলেন, এই সূর্যের বিদ্যুৎ-ছটা আর পৃথিবীর চুম্বকশক্তি আর এই আলেয়ার আলো এই তিনটার মধ্যে ভিতরে ভিতরে খুব একটা সম্পর্ক দেখা যায়। সূর্যটা কেবল যে পৃথিবীকে আলো দেয় আর গরম রাখে তা নয়, সে নানারকম অদৃশ্য তেজে পৃথিবীকে ভিতরে বাইরে সব সময়েই নানানরকমে চঞ্চল করে রাখছে। সর্যের গায়ে যখন ঘূর্ণির মতো দাগ দেখা যায় তখন পৃথিবীতেও চুম্বকের দৌরাত্মে দিগদর্শন যন্ত্রগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে—আর মেরুর আকাশে যেখানে পৃথিবীর এই চুম্বকের মাথা সেখানে এই আলেয়ার আলো আরো দ্বিগুণ উৎসাহে নূতন বাহার দেখিয়ে খেলা করতে থাকে। এগারো বছর পর পর সূর্যের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের এক-একটা বড়ো-বড়ো উৎপাত দেখা যায়-ঠিক সেই সময়েই পৃথিবীতেও চুম্বকের উপদ্রব আর আকাশ আলেয়ার বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে।

 তোমরা জান, পাম্প্ দিয়ে ফুটবলে বাতাস পোরা যায়—কিন্তু একরকম উলটা 'পাম্প' আছে তা দিয়ে বাতাস খালি করে ফেলে। পণ্ডিতেরা এইরকমে বোতলের মধ্যে থেকে

১৯৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২