পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সুক্ষ দানা থাকে, সেইগুলি গলায় জিভে ফুটে মুখের অবস্থা সাংঘাতিক করে তোলে। ওয়েস্ট ইণ্ডিজ দ্বীপে একরকম বেত পাওয়া যায়। তার পাতা খেলে গলা ফুলে কথা তো বন্ধ হয়ই, অনেক সময় দম বন্ধ হয়ে যেতে চায়। শুনা যায়, সেখানকার নিষ্ঠুর দাস-ব্যবসায়ীরা এই পাতা খাইয়ে ক্রীতদাসদের শাসন করত। এই বেতের নাম Dumb Cane বা ‘বোবা বেত'।

 আত্মরক্ষার জন্যেই অধিকাংশ গাছ নানারকমের ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নেয়। কিন্তু কেবল নিজেকে বাঁচিয়েই সকলে সন্তুষ্ট নয়, বংশরক্ষার জন্যে তাদের যে-সব উপায় খাটাতে হয় সেগুলিও এক-এক সময় কম সাংঘাতিক নয়। অনেক গাছের ফল বা বীজ দেখা যায় যেন কাঁটায় ভরা। এইরকম কাঁটাওয়ালা নখওয়ালা ফল সহজেই নানা জানোয়ারের গায়ের চামড়ায় লেগে এক জায়গার ফল আর-এক জায়গায় গিয়ে পড়ে। তাতে জানোয়ারের অসুবিধা খুবই হতে পারে কিন্তু গাছের বংশ বিস্তারের খুব সুবিধা হয়। এক-একটা ফলের কাঁটার সাজ অনাবশ্যকরকমের সাংঘাতিক বলে মনে হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় একরকম ফল হয় সে ফল মানুষে খায় না, তার গুণের মধ্যে তার প্রকাণ্ড দুইটি বঁড়শির মতো শিং আছে, তার একটি কোনো জন্তুর গায়ে বিঁধলে তার সাধ্য কি যে ছাড়িয়ে ফেলে। অনেক সময় দেখা গিয়েছে, এই ফলের কামড় ছাড়াতে গিয়ে গোরু ছাগল বা হরিণের মুখের মধ্যে বঁড়শি আটকে গিয়েছে। পোষা জন্তু হলে মানুষের সাহায্যে সে উদ্ধার পেয়ে যায়, কিন্তু বনের জন্তু নিরুপায়। তারা কেবল অস্থির হয়ে পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়-তাতে আধ-খোলা ফলের ভিতরকার বীচিগুলা চারিদিকে ছিটিয়ে পড়বার সুযোগ পায়, কিন্তু নিরীহ জতুর প্রাণটি যায়। এই ফলকে সে দেশের লোকে ‘শয়তানের শিং' বলে।

 এর চাইতেও ভয়ানক হচ্ছে আফ্রিকার সিংহ মারা ফল। আঁকশির মতো চেহারা, তার চারিদিকে ‘বাঘনখ’ ফলের মতো বড়ো-বড়ো নখ। নখের গায়ে ভীষণরকম কাটা তাদের এক-এক মুখ এক-এক দিকে-একটাকে ছাড়াতে গেলে আর-একটা বেশি করে বিঁধে যায়। প্রতি বছর সে দেশে হাজার হাজার হরিণ, ভেড়া আর ছাগল এইভাবে জখম হয়। যেখানে নখ বসে সেখানে ঘা হয়ে পচে ওঠে, তাতে ফল যদি খসে যায় তা হলে কতক রক্ষা; না হলে শেষটায় প্রাণ নিয়ে টানাটানি। স্বয়ং পশুরাজ সিংহও যে এর হাত থেকে সকল সময়ে নিস্তার পেয়ে থাকেন তা নয়। এর জন্যে সিংহের প্রাণ দিতে হয়েছে এমনও দেখা গিয়েছে।

 আর-এক রকম গাছ আছে, তাদের ফল পাকলে ফেটে যায় আর ভিতরের বীচিগুলা সব ছিটিয়ে পড়ে। কোনো কোনো গাছে এই বীজ ছড়ানো কাজটি বেশ একটু জোরের সঙ্গে হয়। এক বাঁদরের গল্প শুনেছি, সে খুব বাহাদুরি করে গিলার গাছে বসে বসে মুখ ভ্যাংচাচ্ছিল। গিলার ফল হয় বড়ো-বড়ো সিমের মতো—সেগুলো পেকে পটকার মতো আওয়াজ করে ফেটে যায় আর চারিদিকে গিলা ছিটায়, বাঁদর তো সে খবর রাখে না, সে আরাম করে ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে খুব একটা উৎকটরকম দুষ্টুমির ফন্দি আঁটছে, এমন সময় ফট করে গিলা ফেটে তার কানের কাছে চাঁটি মেরে গেল। বাঁদরটা হঠাৎ

২০৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২