পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দেখ, কি বিরাট কাণ্ড। এক-একটি ইঁট এক-একটি প্রকাশ পাথর—তার মধ্যে নিতান্ত ছোটো যেটি, তাহার ওজন পঞ্চাশ মণের কম হইবে না। আর খুব বড়ো-বড়োগুলা এক-একটি হাজার দেড়হাজার মণ।

 কত পাথর। চারিদিকে চাহিয়া দেখ কেবল পাথরের উপর পাথর। না জানি কত বৎসর ধরিয়া কত সহস্র লোকের প্রাণপণ পরিশ্রমে এত পাথর একত্র করিয়া এমন স্তূপ গড়িয়াছে। ভাবিতে গেলে মাথা ঘুরিয়া যায়। প্রায় একশত বিঘা জমির উপরে এই প্রকাণ্ড জিনিসটাকে দাঁড় করানো হইয়াছে। এই কলিকাতা শহরের সমস্ত ঘরবাড়ি ভাঙিয়া যদি পিরামিড গড়িতে যাও দেখিবে তাহাতেও মালমসলায় কুলাইবে না—সমস্ত শহর স্তুপাকার করিয়াও অত বড়ো পিরামিড গড়িতে পারিবে না। অথচ এমন অসম্ভব কাজও মানুষে করিয়াছে। নীল নদীর ওপার হইতে পাহাড় কাটিয়া মানুষ পাথর আনিয়াছে, সেই পাথর নৌকায় তুলিয়া নদী পার করিয়াছে, তার পর দুই মাইল পথ সেই পাথর টানিয়া লইয়াছে, আর ধাপে ধাপে সেই পাথর সাজাইয়া প্রকাণ্ড পিরামিড গড়িয়াছে।

 সে কি অজিকার কথা! প্রায় ছয়হাজার বৎসর হইল, রাজা চেয়প্‌স্ ভাবিয়াছিলেন নিজের গোরস্থান বানাইয়া পৃথিবীতে অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া যাইবেন, সেই কল্পনাই ত্রিশ বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পিরামিডের মূর্তি ধরিয়া দাঁড়াইল।

 এই ছয়হাজার বৎসরে পিরামিডের চেহারা অনেকটা বদলাইয়া গিয়াছে। আগে তাহার উপরে সাদা পাথরের পালিশ করা ঢাকনি ছিল, এখন কেবল দু-এক জায়গায় তাহার একটু-আধটু চিহ্নমাত্র বাকি আছে। একটা পিরামিডের চূড়ায় এখনো সেকালের সেই সাদা ঢাকনিটি লাগিয়া আছে, তাহাতে দেখা যায় যে ছয়হাজার বৎসর আগে পিরামিডের চেহারা কেমন মোলায়েম ছিল। এখন আর তাহার সে চেহারা নাই, চারিদিকে পাথরের ধাপ বাহির হইয়া পড়িয়াছে—চেষ্টা করিলে তাহার সাহায্যে পিরামিডের গা বাহিয়া চূড়ায় উঠা যায়। এমন দুরবস্থা না হইবে-বা কেন? অন্তত দু-তিনহাজার বৎসর ধরিয়া লোকে এই পিরামিডের পাথর বসাইয়া সেই পাথরে নিজেদের ঘরবাড়ি মসজিদ বানাইয়াছে। পিরামিডের কাছাকাছি যত কোঠা দালান তাহার মধ্যে কতগুলা। যে এইরূপ চোরাই মালে তৈরি তাহার আর সংখ্যা নাই।

 ছয়হাজার বৎসর আগেকার মানুষ, তাহারা কেমন করিয়া এত বড়ো-বড়ো পাথর সাজাইয়া এমন পিরামিড গড়িল একালের মানুষ ভাবিয়া তাহার কিনারা পায় না। তবে সেকালের গ্রীক লেখক হেরোডোটস এ-বিষয়ে যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা হইতে পিরামিড বিষয়ে মোটামুটি অনেক সংবাদ পাওয়া যায়।

 তাহাতে দেখা যায় যে নদীর ওপার হইতে পিরামিডের ভিত্তি পর্যন্ত পাথর বহিবার জন্য প্রায় দুইহাজার হাত লম্বা, চল্লিশ হাত চওড়া এক রাস্তা বানাইতে হইয়াছিল। রাস্তা আগোগোড়া পালিশ-করা পাথরের তৈরি, তার একদিক প্রায় বত্রিশ হাত উঁচু, আর-একদিক ক্রমে তালু হইয়া নদী পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে। একলক্ষ লোক ক্রমাগত দশ বৎসর পরিশ্রম করিয়া এই রাস্তা বানাইয়াছিল। যতক্ষণ রাস্তা বানানো হইতেছিল, ততক্ষণে আর-

নানা নিবন্ধ
২১১