পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শুনিলে অবাক হইতে হয়। ফিণ্ডার্স আর বাস্ নামক দুই ইংরাজ ছোকরা নানা জায়গায় ঘুরিয়া অনেক নুতন স্থানের সংবাদ আনিয়াছিল। একটা সামান্যরকমের নৌকায় চড়িয়া তাহারা নদীতে ও সমুদ্রে পাড়ি দিয়া ফিরিত, ফিল্ডার্স বড়ো আমুদে লোক ছিল, সে একবার কতগুলী সেদেশী লোকের হাতে পড়ে। তাহাদের ভাবগতিক মোটেই সুবিধামতো ছিল না, তাই তাহাদের খুশি রাখিবার জন্য সে নানারকম কাণ্ড করিয়াছিল। এমন-কি, শেষটায় রসিকতা করিয়া তাহাদের কয়েকজনের দাড়ি পর্যন্ত কাঁচি দিয়া ছাঁটিয়া দিয়াছিল। তাহাতে সেই লোকেরা নাকি ভারি খুশি হইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দেয়।

 অস্ট্রেলিয়ার অজানা দেশে যাওয়া বড়োই বিপদের কথা। লোকের অত্যাচার আর মরুভূমি তো আছেই, তাহার উপর মাঝে মাঝে এমন চোরামাটি যে তাহার উপর চলিতে গেলে পাঁকে ডুবিয়া মরিতে হয়। সে দেশের নদীগুলাও কেমন বেয়াড়া, তাহাদের মতিগতির যেন কিছুই স্থির নাই। লেফটেনাণ্ট অক্সলি এক জায়গায় প্রকাণ্ড নদী দেখিয়াছিলেন, সে নদীতে বান আসিয়া তাঁহাকে অনেকবার নাকাল করিয়াছিল। ছয় বৎসর পরে কাপ্তান স্টার্ট সেইখানে গিয়া দেখেন খটখটে শুকনা ডাঙা, তাহার মাঝে মাঝে ছোটোখাটো বিলের মতো—নদীর চিহ্নমাত্র নাই!

 ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে আয়ার নামে এক সাহেব অস্ট্রেলিয়ায় মাঝখানের অজানা দেশটা দেখিবার জন্য বাহির হন। তিনি দক্ষিণ হইতে উত্তরে চলিতেছিলেন-দিনের পর দিন চলিয়া কেবল লাল বালি আর শুকনা হ্রদ ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পান না; তার পর তিনি পশ্চিমমুখে গিয়া সেদিকেও সামান্য কাঁটাঝোপ ছাড়া আর কোনো গাছ পাইলেন না। জলের কষ্ট এত বেশি যে চল্লিশ দিনে তিনি দেড়শত মাইল পথও যাইতে পারেন নাই-বার বার জলের জন্য ফিরিতে হইত। অন্য কোনো লোক হইলে সেইখানে উৎসাহ নিভিয়া যাইত, কিন্তু আয়ার বলিলেন, সমুদ্র না পাওয়া পর্যন্ত এইভাবে চলিব, নাহয় মরিব। লোকজন সকলে বিদায় লইল, সঙ্গে রহিল কেবল ব্যাকস্টার নামে এক সাহেব আর তিনটি সেদেশী লোক। চলিতে চলিতে মরুভূমির ধুলায় তাঁহাদের চোখ অন্ধপ্রায় হইয়া আসিল, জলের কষ্ট অসহ্য হইয়া উঠিল, তাঁহাদের ঘোড়াগুলি একে একে পড়িয়া মরিল, সঙ্গের ছাগল-ভেড়াগুলিও দুর্বল হইয়া মরিতে লাগিল, তার উপর কোথা হইতে একরকম মাছি আসিয়া দেখা দিল, তাহার কামড়ের যন্তণায় সর্বাঙ্গ জ্বলিতে থাকে। খাবার জিনিস যখন ফুরাইয়া আসিল, তখন সঙ্গের দুটি লোক ব্যাকস্টারকে মারিয়া খাবার চুরি করিয়া পলাইল। একজন মাত্র দেশী লোক সঙ্গে লইয়া আয়ার চলিতে লাগিলেন। একটি ঘোড়া তখনো বাঁচিয়াছিল, তাহারা সেইটিকে মারিয়া তার কাঁচা মাংস খাইলেন। সেই মাংসও যখন পচিয়া উঠিল তখন কেবল এক-এক মুঠা ময়দা জলে গুলিয়া তাহাতেই একদিনের আহার চালাইতে লাগিলেন। শেষটায় এমন দিন আসিল যখন ময়দাও ফুরাইয়া গেল। সেদিন খালি পেটে ঘুরিতে ঘুরিতে তাঁহারা এক অজানা সমুদ্রের ধারে আসিয়া দেখেন কোথা হইতে এক জাহাজ আসিয়াছে। আর কতগুলি ফরাসী নাবিক নৌকায় করিয়া তীরে আসিয়া উঠিয়াছে। আয়ার অবাক, নাবিকেরাও অবাক। এমনি করিয়া মরিতে মরিতে আয়ার বাঁচিয়া গেলেন।

২১৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২