পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মানুষের কথা

 জগতে কাহারও স্থির থাকিবার হুকুম নাই। জ্যোতির্বিদ বলেন, “চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবী সমস্তই চলিতেছে।” জড় বিজ্ঞানের পণ্ডিত বলেন, “প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে তাহার অতি সূক্ষ্ম অণুপরমাণু পর্যন্ত ছুটাছুটি করিতেছে।” ভূতত্ত্ববিদ বলেন, “এই পৃথিবীকে আজ যেমন দেখিতেছি, চিরদিন সে এমন ছিল না এবং পরেও এমন থাকিবে না—তাহার চেহারা পর্যন্ত যুগের পর যুগ বদলাইয়া চলিয়াছে।” সুতরাং মানুষ যে চিরকাল মানুষ ছিল না, সে যে ক্রমে এইরকম ভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, ইহা কিছুই আশ্চর্য কথা নয়। কোন আদিম কালের কোন জন্তু কেমন করিয়া ক্রমে মানুষের মতো হইয়া উঠিল, তাহার সমস্ত ইতিহাস জানিবার কোনো উপায় নাই। যতটুকু জানা যায় তাহাতে মানুষের সঙ্গে বানরের, বিশেষত বনমানুষের জ্ঞাতি সম্পর্কটাই স্পষ্ট হইয়া ওঠে।

 চোখে দেখিতে মানুষ ও বানরের চেহারার মধ্যে যেমন মিল দেখিতে পাই, তেমনি কতগুলা তফাতও বুঝতে পারি, যাহার দরুন বানরকে বানর বলিয়া বোঝা যায়। একটা মানুষের আর একটা গরিলার কংকাল পাশাপাশি লইয়া দেখিবে দুজনের শরীরের গড়ন মোটামুটি একইরকমের। একইরকম ভাবে হাড়ের পরে হাড় সাজাইয়া কাঠামো দুটিকে দাঁড় করানো হইয়াছে। বাঘ সিংহ বা গোরু ঘোড়ার কংকাল যদি ইহার পাশে বসাও তবে কখনই এতটা মিল দেখিতে পাইবে না। কিন্তু এতটা মিল থাকিলেও দুয়ের মধ্যে তফাতটাও বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়। গরিলার হাত প্রকাণ্ড লম্বা এবং মজবুত, কারণ তাহাকে গাছে গাছে ফিরিতে হয়, চলিতে-ফিরিতে তাহাকে হাতের ব্যবহার করিতে হয়। গরিলার পায়ের পাতা ঠিক হাতেরই মতো অর্থাৎ বলিতে গেলে তাহার চারিটাই হাত। তাহার শরীরে যে অসাধারণ শক্তি, তাহার পাঁজরের হাড়গুলী দেখিলেই সেটা বেশ বোঝা যায়। তার পর মাথার খুলিটা-গরিলার দাঁত এবং চোয়াল খুবই মজবুত কিন্তু আসল মাথাটুকু অর্থাৎ মগজের জায়গাটুকু মানুষের তুলনায় খুব ছোটো। মানুষকে বুদ্ধি খাটাইয়া বাঁচিতে হয়, তাই তাহার মগজ বাড়িয়া মাথাটাকে বড়ো করিয়া তুলিয়াছে। আরো কতগুলা সূক্ষ তফাত আছে পণ্ডিতেরা যাহাকে গুরুতর বলিয়া মনে করেন, যেমন হাঁটুর হাড়। মানুষ যে পায়ের পাতার উপর খাড়া হইয়া চলে এবং গরিলা যে সামনের হাত দুটিতে ভর রাখিয়া কুজা হইয়া চলে, হাঁটুর হাড় দেখিয়াই পণ্ডিতেরা তাহা বলিয়া দিতে পারেন।

 মানুষ কতদিন হইল এ পৃথিবীতে আসিয়াছে অর্থাৎ কতদিন হইল সে ‘মানুষ’ হইয়াছে, তাহা পণ্ডিতেরা এখনো ঠিক করিতে পারেন নাই। সকলের চাইতে পুরাতন মানুষের চিহ্ন যাহা পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের চোয়ালের হাড় আর মুখের ভিতরকার গড়ন দেখিয়া মনে হয় তাহারা কথা বলিতে জানিত না। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে ডাক্তার ডুবয় যবদ্বীপে প্রাচীন জন্তুর কংকাল খুঁজিতে গিয়া একটা মানুষের কয়েক টুকরা কংকাল খুঁড়িয়া তোলেন। সেটা মানুষের কংকাল কি বানরের কংকাল, সে বিষয়ে প্রথমে

২২২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২