পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জ্বালাইবার উপায় বাহির করিয়াছিল, আজও পৃথিবীর কত অসভ্য জাতি ঠিক সেই উপায়ে প্রতিদিন আগুন জ্বালিতেছ। এই কাজ করিতে কৌশল ও পরিশ্রম দুয়েরই দরকার হয়। কাঠের মধ্যে কাঠ ঘুরাইয়া আগুন জ্বালিবার প্রথা আমাদের দেশে বহুকাল হইতে প্রচলিত ছিল-বেদে এবং পুরাণে তার কথা অনেক স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকবার এইভাবে আগুন জ্বালানো বড়ো সহজ কথা নয়, সেইজন্য একবার আগুন জ্বালানো হইলে তাহাতে বার বার কাঠ-কুটা শুকনা পাতা ইত্যাদি দিয়া সেই আগুনকে বাঁচাইয়া রাখা দরকার হইত। কেবল আমাদের দেশে নয়, এইরকম আগুন রক্ষার আয়োজন রোম গ্রীস ইজিপ্ট প্রভৃতি সকল দেশেই ছিল। অনেক সময় রীতিমতো মন্দির গড়িয়া পুরোহিত রাখিয়া এই আগুনের তদ্বির করা হইত। লোকে সেই-সকল মন্দির হইতে প্রতিদিন আগুন লইয়া আসিত এবং সকলে মিলিয়া আগুনের সম্মান ও পূজা করিত।

 আগুন না থাকিলে মানুষের অবস্থা কি হইত? আগুন ছিল তাই মানুষ শীতের মধ্যেও টিকিতে পারিয়াছে, কত হিংস্র জন্তর হাত হইতে আপনাকে বাঁচাইতে পারিয়াছে, রান্না করিতে শিখিয়াছে, মাঠি পোড়াইয়া বাসন গড়িতে শিখিয়াছে, লোহা তামা প্রভৃতি ধাতুকে কাজে লাগাইতে শিখিয়াছে। শহরে গ্রামে ঘরের আশেপাশে সর্বদা যে-সব জিনিস কাজে লাগে, তাহার দিকে চাহিয়া দেখ, আগুন না হইলে তাহার কোনটা তৈয়ারি করা সম্ভব হইত? মাটির হাঁড়ি, কাঁসার বাসন, সোনা রূপার অলংকার এ-সব তো ছাড়িয়াই দিলাম। জুতাটি যে পায়ে দিয়াছ, তাহার কাঁটাগুলি তো লোহার, ঐ জুতা সেলাইয়ের জন্য লোহার ছুঁচ দরকার হইয়াছিল তো? আগুন না থাকিলে তাহা সম্ভব হইত কিরূপে? ঘরে এত যে সাবান সুগন্ধি ওষুধপত্র ব্যবহার কর, তাহার মালমসলার জন্য কত কারখানায় কত চুল্লি জ্বালিতে হয় তাহা একবার ভাবিয়া দেখ তো। রাত্রে যে আলো জ্বালাইয়া পড়াশুনা কর, সেই আলোটুকু যদি না থাকিত তবে কেমন অসুবিধা হইত বল দেখি। আর ঐ যে কাঁচের চশমা পর, কাঁচের ‘থার্মোমিটার' দিয়া জ্বর মাপ, আর অণুবীক্ষণ দূরবীক্ষণ প্রভৃতি অসংখ্য কাঁচের যন্ত্র ব্যবহার কর, ক্ষার চুণ ও বালি আগুনে না গলাইলে সে কাচ আসিত কোথা হইতে? আগুন ছাড়া পৃথিবী যদি কল্পনা করিতে চাও তো এই-সমস্ত জিনিস বাদ দিতে হয়—এই-সমস্ত জিনিসের সাহায্যে মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞান ও সত্যতায় যাহা কিছু উন্নতি লাভ করিয়াছে সে-সমস্ত লোপ করিতে হয়। আর মানুষকে কল্পনা করিতে হয় সেই আদিম কালের অসভ্যের মতো—যাহারা ফলমূল ও কাঁচা মাংস খাইয়া, গাছের ছাল-বাকল ও জানোয়ারের চামড়া পরিয়া, গাছ পাথরের অস্ত্রে সাজিয়া, গাছে জঙ্গলে গুহা গহ্বরে লুকাইয়া ফিরিত। সে সময়ের পৃথিবীতেও কাঠ ছিল, কয়লা ছিল, আগুন জ্বালিবার মালমসলা সবই ছিল। ছিল না কেবল আগুন–ছিল না কেবল সেই জ্ঞানটুকু যাহাতে আগুন জ্বালিবার সংকেতটি জানা যায়। সেই মানুষ, আর এখনকার এই মানুষ! এ দুয়ের মধ্যে এত যে প্রকাণ্ড তফাত দেখিতেছ, তাহার প্রধান কারণ এই আগুনের আবিষ্কার।

 আমাদের দেশে আগুনকে বলে,'সর্বভুক’। একবার যদি সে জিভ মেলিয়া বাহির হইল, তবে তাহার ক্ষুধার আর শেষ নাই—সে তখন সব খাইয়া উজাড় করিতে পারে। আগুনকে যদি তুষ্ট করিতে চাও, কাজে লাগাইতে চাও, তবে তাহার ক্ষুধা মিটাইর খোরাক দেওয়া

নানা নিবন্ধ
২৩১