পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চাই। কাগজ দাও, খড় দাও, কাঠ দাও, কয়লা দাও, তেল ঘি কেরোসিন যাহা সে হজম করিতে পারে তাহাই দাও-একটা কোনো খোরাক না জোগাইলে সে জ্বলিতে পারে না। আগুন জ্বালিবার জন্য মানুষে প্রতি বৎসর কত বন জঙ্গল উজাড় করে, মাটির ভিতরে ঢুকিয়া কত লক্ষ লক্ষ মণ কয়লা খুঁড়িয়া তোলে, কত বড়ো-বড়ো ব্যবসা ফাঁদিয়া কেরোসিন প্রভৃতি খনির তেল দেশ-বিদেশে চালান দেয়, কত মোম চর্বি ঘি তেল খরচ করিয়া ঘরে ঘরে বাতি জ্বালায়, তাহার হিসাব লইতে গেলে অবাক হইতে হয়। আজকালকার নিতান্ত অসভ্য মানুষ-লঙ্কা দ্বীপের ‘ভেদ্দা' বা আফ্রিকার ‘বুশম্যান’—তাহারাও আগুনের ব্যবহার জানে। অতি প্রাচীন কালে আগুন ছাড়া মানুষ যাহারা ছিল তাহারা যে আগুনওয়ালা মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়া টিঁকিতে পারিত না, এ কথা সহজেই বোঝা যায়। শীতের অত্যাচারে, শত্রুর অত্যাচারে, হিংস্র জন্তর অত্যাচারে-নানারকম বিপদে আপদে আগুনের সাহায্য না পাইলে আজকালকার এই মানুষেরা আজ কোথায় থাকিত, কে জানে? হয়তো মানুষ জাতিটাই পৃথিবী হইতে লোপ পাইবার জোগাড় হইত।

 হিংস্র জন্তু পোষ মানিলেও তাহার হিংস্রতা একেবারে দূর হয় না। সেইজন্য সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়, কখন তাহার হিংসা বুদ্ধি জাগিয়া উঠে। আগুনকে বাগ মানাইতে গিয়াও মানুষকে পদে পদেই এইরকম বিপদে পড়িতে হইয়াছে। আমরা একবার শিলং পাহাড়ে গিয়াছিলাম। সেখানে পাহাড়ের গায়ে লম্বা লম্বা দাগ দেখিয়া দূর হইতে ভাবিয়াছিলাম, ওগুলি বুঝি পাহাড়ে উঠিবার রাস্তা। পরে কাছে গিয়া বুঝিলাম ওগুলি রাস্তা নয়, জঙ্গলের মাঝে মাঝে চওড়া ফিতার মতো ফাঁকা জমি-ঠিক যেন পাহাড়ের মাথার উপর ক্ষুর চালাইয়া খালের মতো করিয়া চাচিয়া রাখিয়াছে! শুনিলাম, আগুনের ভয়ে নাকি ওরকম করা হইয়াছে। কোথাও আগুন লাগিলে, ঐ ফাঁকা জায়গা পর্যন্ত আসিয়া অগুন আর ছড়াইতে পারে না। আমেরিকার বড়ো-বড়ো Prairie বা ঝোপজমিতে কেবল ঝোপজঙ্গল ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না-সেখাম আগুন লাগিলে এক-এক সময়ে ব্যাপার ভারি মারাত্মক হইয়া দাঁড়ায়। সে আগুন এমন হু হু করিয়া ছড়াইয়া পড়ে যে মানুষে অনেক সময়ে ঘোড়া ছটাইয়াও তাহার হাত এড়াইয়া পলাইতে পারে না।

 এ-সব তো গেল বাহিরের আগুনের কথা। মানুষের ঘরে ঘরে সংসারের কাজের জন্য প্রতিদিন যে আগুনের দরকার হয়, সেই আগুন যখন এক-একবার ছাড়া পাইয়া ঘরবাড়ি শহর গ্রাম সব খাইয়া শেষ করে, তাহাও কি কম সাংঘাতিক! কখন কাহার অসাবধানতায় আগুন ছড়াইয়া সর্বনাশ উপস্থিত হয়, তাহার জন্য কতরকমে মানুষকে সতর্ক হইতে হয়। বড়ো-বড়ো শহরে দমকলের স্টেশন থাকে, আগুন নিভাইবার জন্য কত লোকলস্কর ও কতরকম আয়োজন রাখিতে হয়। বড়ো-বড়ো দমকল, যাহা হইতে জলের ফোয়ারা ছুটিয়। আগুনের মধ্যে গিয়া পড়ে; তিনতলা চারতলার সমান লম্বা লম্বা মই, যাহাকে দুরবীনের মতো গুটাইয়া রাখা যায়; আর বড়ো-বড়ো মোটর বা ঘোড়ার গাড়ি, যাহাতে আগুনের জায়গায় চট‌্‌পট্ ছুটিয়া যাওয়া যায়; আর আগুন লাগিলে পর আগুনের আফিসে তাড়াতাড়ি খবর পৌঁছাইবার জন্য নানারকম ব্যবস্থা। টেলিফোনের আফিসে একটিবার ‘ফায়ার!' (Fire) বলিয়া খবর দাও, অমনি মুহুর্তের মধ্যে আগুনস্টেশনের সাড়া শুনিবে—“কোথায় আগুন?”

২৩২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২