পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এমনি সমস্ত আয়োজন করে কোম্পানির জাহাজ রওনা হল। কিন্তু পাঁচ মাইল যেতে না যেতেই হঠাৎ কোথায় টান লেগে তারের লাইন ছিঁড়ে গেল। তখন ফিরে এসে তীরের দিক থেকে সমস্ত তারটিকে টেনে টেনে, তার ভাঙা মুখ বার করে তার সঙ্গে নুতন তার জুড়ে জাহাজ আবার পশ্চিমে চলল। দু-তিন দিন নিরাপদে চলতে চলতে প্রায় চারশো মাইল তার বসাবার পর হঠাৎ ব্রেক কষাবার দোষে তার ছিঁড়ে আড়াই মাইল গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গেল। জাহাজের লোকে হতাশ হয়ে বন্দরে ফিরে চলল, কোম্পানির সাড়ে তিনলক্ষ টাকার মাল (চারশো মাইল তার) সমুদ্রের নীচেই পড়ে রইল।

 পরের বৎসর আবার নূতন করে চেষ্টা আরম্ভ হল। এবার স্থির হল এই যে, সমুদ্রের মাঝখানে দুই জাহাজের তীরের মুখ একত্র করে তার পর দুই জাহাজ দুই দিকে তার বসিয়ে চলবে—একটা যাবে আমেরিকার দিকে, আরেকটা আয়ার্ল্যাণ্ডের দিকে। মাঝসমুদ্রে যাবার পথে এমন ঝড় উঠল যে তেমন ঝড় খুব কমই দেখা যায়। সপ্তাহ ভরে ঝড়ের আর বিরাম নাই। তারের ভারে বোঝাই জাহাজ ঝড়ের ধাক্কায় ডোবে-ডোবে অবস্থায় সমুদ্রের মধ্যে নিরুপায় হয়ে মাতালের মতো টলতে লাগল। অনেক কষ্টে প্রাণ বাঁচিয়ে ষোলো দিন পর তারা মাঝ সমুদ্রে হাজির হল। তার পর এর-লাইন ওরলাইনে জুড়ে দিয়ে তারা দুইজনে দুই মুখে চলল। তারের ভিতর দিয়ে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজ পর্যন্ত বিদ্যুতের সংকেত চলছে কিন্তু চল্লিশ মাইল পার না হতেই হঠাৎ সংকেত বন্ধ হয়ে গেল, এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজের কোনো সাড়াই পাওয়া যায় না। আবার দুই জাহাজ মুখোমুখি হয়ে তারের সঙ্গে তার জুড়ে দুই দিকে ছুটল। এবারের দৌড় একশো মাইল। তার পরেই আর সাড়াশব্দ নাই—আবার কোথায় লাইন ফেঁসে গেছে। আরম্ভেই দুই-দুইবার ব্যাঘাত পেয়ে আর নানারকমে নাকাল হয়ে জাহাজ আবার নিরাশ হয়ে ফিরে এল। লাভের মধ্যে, 'কোম্পানিকা মাল, দরিয়ামে ঢাল।'

 এইবার কোম্পানির উৎসাহ প্রায় নিভে এসেছিল। অনেকেই পরামর্শ দিলেন যে, এ অসম্ভব কাজের পিছনে আর অনর্থক টাকা নষ্ট করা উচিত নয়। কোম্পানির বড়োবড়ো পাণ্ডারা পর্যন্ত বলতে লাগলেন, এখন তারের লোহালক্কড় সব বিক্রি করে টেলিগ্রাফ কোম্পানির কারবার বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। কেবল দু-একজন উৎসাহী লোক বলল যে, তারা এখনো হার মানতে প্রস্তুত নয়। শেষটায় সেই দু-একজনেরই বিশেষ চেষ্টায় সেই বছরেই আর একবার প্রাণপণ আয়োজন করে, অনেকরকম হাঙ্গামার পর আয়ার্ল্যাণ্ডথেকে আমেরিকা পর্যন্ত নিরাপদে লাইন বসানো হল—টেলিগ্রাফ কোম্পানির জয়-জয়কার পড়ে গেল। তখন এদেশের সিপাহী বিদ্রোহ সবেমাত্র শেষ হয়েছে—কিন্তু সে খবর তখনও আমেরিকায় পৌঁছায় নি। বিদ্রোহের জন্য কানাডা থেকে দুই দল ইংরাজ সৈন্য এ দেশে আসবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। তারের লাইন বসানো হতেই ইংল্যাণ্ড থেকে খবর গেল, 'সৈন্য পাঠাবার দরকার নাই।' ঐ খবর যদি না যেত তা হলে মিছামিছি সৈন্য পাঠিয়ে, গভর্নমেণ্টের অন্তত সাতলক্ষ টাকা খামখা বাজে খরচ হয়ে যেত। এই কথাটা প্রচার হওয়াতে টেলিগ্রাফ কোম্পানির খুব বিজ্ঞাপন হয়ে গেল। সমুদ্র পার করে টেলিগ্রাফ

২৪৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২