পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাঠাবার সুবিধা যে কি, মানুষকে তা বোঝাবার জন্য আর বেশি ব্যাখ্যা বা বক্তৃতা দরকার হল না। তুমুল উৎসাহে টেলিগ্রাফ কোম্পানির ব্যবসার আরম্ভ হল।

 কিন্তু হায়! কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই টেলিগ্রাফের সাড়া ক্ষীণ হতে হতে একদিন একেবারেই সব বন্ধ হয়ে গেল—এপারের বিদ্যুৎ আর ওপারে পৌঁছায়ই না। এত সাধের টেলিগ্রাফ-লাইন, তার কিনা এই অকাল মৃত্যু-তিন মাসও তার আয়ু হল না। পণ্ডিতেরা পরীক্ষা করে বললেন যে, তারের মধ্যে যে বিদ্যুৎ চালানো হয়েছে—সেই বিদ্যুতের তেজ খুব বেশি হওয়াতেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

 তার পর সাত বৎসর গেল আবার নূতন করে লাইন বসাবার আয়োজন করতে। অনেকরকম আলোচনা আর পরীক্ষার পর, আরো মজবুত করে নুতন তার তৈরি হল। সেই তারের লাইন প্রকাণ্ড এক জাহাজে করে সমুদ্রে পাঠানো হল। জাহাজ চুয়াল্লিশ মাইল সমুদ্র পার হতেই বোঝা গেল, তারের মধ্যে কোথাও গলদ রয়ে গেছে। সেটা খুঁজে মেরামত করে তার পর সাতশো মাইল পর্যন্ত বিনা উৎপাতে গিয়ে আবার এক মারাত্মক গলদ। আবার অনেক মাইল তার গুটিয়ে নিয়ে তার পর এক জায়গায় প্রকাণ্ড জখম পাওয়া গেল। সেইটুকু দেখে মেরামত করতে প্রায় দশ ঘণ্টা সময় নষ্ট হল। প্রায় বারশো মাইল যাবার পর আবার সেইরকম বাধা। আবার সেই গভীর সমুদ্র থেকে তার টেনে তুলে, কোথায় দোষ আছে খুঁজে বার করে মেরামত করতে হবে। কিন্তু এবারে মাইলখানেক তার গুটিয়ে তুলতেই বাকি তারটুকু চোখের সামনেই পট করে ছিঁড়ে জলের মধ্যে ফস্কে পড়ল।

 জাহাজের কর্তারা পরামর্শ করলেন, আঁকড়শি দিয়ে ঐ তার তুলতে হবে। প্রকাণ্ড লোহার শিকলের আগায় অদ্ভুত নখওয়ালা যন্ত্র ঝুলিয়ে, তাই দিয়ে নাবিকেরা সমুদ্রের তলায় হাতড়াতে লাগল। একবার মনে হল আঁকড়শিতে তার আঁকড়িয়েছে—অমনি টানাটানির ধুম পড়ে গেল। প্রায় আড়াই মাইল গভীর সমুদ্র, তার নীচ পর্যন্ত শিকল নেমেছে, সে শিকল গুটিয়ে তোলা কি সহজ কথা! এক হাত দু হাত, দশ হাত বিশ হাত, একশো হাত দুশো হত, এমনি করে প্রায় মাইলখানেক শিকল তুলবার পর তারে-গাঁথা আঁকড়শিসুদ্ধ দেড়মাইল শিকল ছিড়ে জলের মধ্যে অন্তর্ধান! তখন মোটা শনের দড়ি দিয়ে আবার সমুদ্রের মধ্যে নূতন করে আঁকড়শি ফেলা হল। তিন-চারদিন ক্রমাগত চেষ্টার পর আবার তারের লাইন আঁকড়িয়ে পাওয়া গেল। কিন্তু এবারেও তুলবার সময় তারের ভারে দড়িদড়া সব ছিড়ে আঁকড়শিটা জলের ভিতর তলিয়ে গেল। তার পর আরো দুইখানা আঁকড়শি এইরকমে হারিয়ে জাহাজের শিকল দড়ি সব প্রায় শেষ করে ইংল্যাণ্ডের জাহাজ ইংল্যাণ্ডেই ফিরে চলল।

 এতদিনের আশা ভরসার পর এইরকম দুঃসংবাদ। কিন্তু মানুষের প্রতিজ্ঞার কি জোর। পরের বৎসর (১৮৬৬) সেই জাহাজ আবার নুতন তার বোঝাই করে নুতন উৎসাহে সমুদ্রে বেরুল-দুই সপ্তাহের মধ্যে সে জাহাজ সারা সমুদ্র লাইন বসিয়ে আমেরিকার টেলিগ্রাফ স্টেশন পর্যন্ত তার জুড়ে ফেলল। তখনকার আনন্দের কথা বর্ণনায় শেষ করা যায় না। কোম্পানির একজন এঞ্জিনিয়ার সে সময়ে লিখেছিলেন, “যখন

নানা নিবন্ধ
২৪৫