পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তার বসানো শেষ হল, তোপের গর্জন আর মানুষের আনন্দধ্বনির মধ্যে জাহাজের নাবিকেরা পাগলের মতো চীৎকার করতে লাগল, তখন গৌরবে আমারও শরীরের রক্ত প্রবল বেগে আমার বুকের মধ্যে তোলপাড় করছিল। কতগুলো লোক লাইনের তার ধরে নেচে নেচে গাইতে লাগল। কেউ কেউ পাগলের মতো তারটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। চোখের জলে আনন্দের কোলাহলে হাসিকান্না সব মিশিয়ে সকলে মিলে মহোৎসব লাগিয়ে দিল।”

 এখানেও তাদের উৎসাহের শেষ হয় নি। সেই জাহাজ আবার ফিরে গিয়ে আঠারো দিন অজানা সমুদ্রের ভিতর হাতড়িয়ে, আগেরবারের সেই হারানো লাইন উদ্ধার করে, সেই লাইনকেও আমেরিকা পর্যন্ত পৌছে দিল। এতদিনে, প্রায় চারকোটি টাকা নষ্ট করবার পর, কোম্পানির কারবারের পাকা প্রতিষ্ঠা হল।

সন্দেশ—আষাঢ়, ১৩২৬


শনির দেশে

 কেউ যদি বলে যে, এই পৃথিবীর বাইরে যেখানে বলবে, সেখানে নিয়ে তোমাদের তামাশা দেখিয়ে আনবে-তা হলে তোমরা কোথায় যেতে চাও? আমি জানি, সেরকম হলে আমি নিশ্চয় শনিগ্রহে যেতে চাইব। পৃথিবীর আকাশে আমরা শুধু চোখে যতটুকু দেখতে পাই, তাতে মনে হয় যে, সব চাইতে সুন্দর জিনিস হল চাঁদ। সেখানে একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক, এই পৃথিবীটাকে কেমন মস্ত আর জমকাল চাঁদের মতো দেখায়, সেটা নিশ্চয়ই একটা দেখবার মতো জিনিস। কিন্তু শনিগ্রহে যাবার পথে সেটা আমরা দেখে নিতে পারব।

 যাক, মনে কর যেন শনিগ্রহে যাত্রা করাই স্থির হল। মনে কর এমন আশ্চর্য আকাশ-জাহাজ তৈরি হল যাতে পৃথিবী ছেড়ে, পৃথিবীর বাতাস ছেড়ে ফাঁকা শূন্যের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া যায়। তোমার বয়স কত? দশ বৎসর? বেশ তা হলে ১৯১১ খৃস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা স্বপ্ন-জাহাজে রওনা হলাম শনিগ্রহে যাবার জন্য। আমাদের জাহাজটা মনে কর খুব দ্রুত এরোপ্লেনের মতো ঘণ্টায় একশো মাইল বা একশো পঁচিশ মাইল করে চলে।

 আমরা আকাশের ভিতর দিয়ে হু হু করে চলেছি আর পৃথিবীর ঘরবাড়ি সব ছোটো হতে হতে একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে। বড়ো-বড়ো শহর, বড়ো-বড়ো নদী, সব বিন্দুর মতো, রেখার মতো হয়ে আসছে। এই গোল পৃথিবীর গায়ে পাহাড় সমুদ্র, দেশ মহাদেশ ক্রমে সব ততি নিখুঁত মানচিত্রের মতো দেখা যাচ্ছে। ঐ ফ্যাকাশে হলদে মরুভূমি, ঐ ঘন সবুজ বন, ঐ ছেয়ে-নীল সমুদ্র, ঐ সাদা সাদা বরফের দেশ। মভেম্বর মাসে আমরা, এখান থেকে চাঁদ যতদূর, ততদূর চলে গিয়েছি। এক বছরে ১৯২০ খৃস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা প্রায় দশ লক্ষ মাইল এসে পড়েছি। পুথিবী থেকে চাঁদটাকে যেমন দেখি এখন পৃথিবীটাকে

২৪৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২