পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঠিক তেমনি দেখাচ্ছে। হিমালয় পাহাড়কেও আর পাহাড় বলে ভালো বোঝাই যাচ্ছে না। চাঁদের যেমন অমাবস্যা পূর্ণিমা হয়, দিনে দিনে কলায় কলায় বাড়ে কমে, পৃথিবীরও ঠিক তেমনি। এমনি করে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে, কিন্তু কই? শনিগ্রহ তো একটুও কাছে আসছে বলে মনে হয় না। শুনেছিলাম সে এক প্রকাণ্ড গ্রহ, তার চারিদিকে আংটি ঘেরা। কিন্তু তোমার তো বিশ বছর বয়স হল, গোঁফদাড়ি বেরিয়ে গেল, এখনো তো সে-সবের কিছুই দেখা গেল না! ঐ লাল রঙের মঙ্গলগ্রহটা যেন একটুখানি কাছে এসেছে, কিন্তু সেও তো খুব বেশি নয়। আমাদের বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতটি বলছেন, মঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছতে আরো চল্লিশ বৎসর লাগবে। ও হরি। তা হলে শনিতে পৌছব কবে? শনি পর্যন্ত যেতে লাগবে প্রায় আটশো বৎসর। তা হলে উপায়? একমাত্র উপায়, আরো বেগে যাওয়া। আরো পাঁচ গুণ দশ গুণ বিশ গুণ বেগে কামানের গোলার মতো বেগে ঘটায় দুহাজার মাইল বেগে ছুটতে হবে। তাই ছোটা যাক।

 আরো দুই বৎসরে মঙ্গল পর্যন্ত এসে পড়া গেল। ওখানে গিয়ে একবার নামলে মন্দ না। ঐ লম্বা-লম্বা আঁচড়গুলা সত্যিকারের খাল কিনা, ওখানে সত্যি সত্যি বুদ্ধিমান জীব কেউ আছে কিনা, একটিবার খবর নেওয়া যেত। কিন্তু আমাদের তো অত অবসর নেই, যেমনভাবে চলছি এমনি করে চললেও শনিতে পৌঁছতে আরো অন্তত চল্লিশ বৎসর লাগবে। সুতরাং সোজা চলতে থাকি।

 মঙ্গলের পথ পার হয়ে এখন বৃহস্পতির দিকে চলেছি। মাঝে মাঝে ছোটো-বড়ো গোলার মতো ওগুলো কি সামনে দিয়ে হু করে ছুটে পালাচ্ছে? কোনোটা দশ মাইল, বিশ মাইল, কোনোটা একশো মাইল বা দুশো মাইল চওড়া-আবার কোনোটা ছোটোখাটো ঢিপির মতন বড়ো, কোনো কোনোটা সামান্য গুলি-গোলার মতো। এরা সবাই গ্রহ। যে নিয়মে বড়োবড়ো গ্রহেরা সূর্যের চারিদিকে চক্র দিয়ে ঘোরে—এরাও প্রত্যেকেই, এমন-কি, যেগুলি ধুলিকণার মতো ছোটো সেগুলিও, ঠিক সেই নিয়মেই নিজের নিজের পথে নিজের নিজের তাল বজায় রেখে সূর্যের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়।

 এমনি করে ছুটতে ছুটতে আরো দশ বৎসর কেটে গেল, ছোটো ছোটো গ্রহগুলিকে আর যেন দেখাই যায় না। পৃথিবী সূর্যের আশেপাশে মিট্‌মিট্ করে জ্বলছে। সূর্যও দেখতে অনেকখানি ছোট্টো হয়ে গেছে—সেই পৃথিবীর সূর্য আর এই সূর্য যেন ফুটবলটার কাছে একটি ক্রিকেট বল। ক্রমে আরো আট-দশ বছর ছুটে, গ্রহরাজ বৃহস্পতির চক্রপথের সীমানায় এসে হাজির হওয়া গেল। কোথায় পৃথিবী আর কোথায় বৃহস্পতি। তিনশোপঁয়ষট্টি দিনে পৃথিবীর এক বৎসর-কিন্তু বৃহস্পতি যে প্রকাণ্ড পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সেই পথে একবার পাড়ি দিতে তার প্রায় বারো বৎসর সময় লাগে। ধোঁয়ায় ঢাকা প্রকাণ্ড শরীর—তার মধ্যে হাজার খানেক পৃথিবীকে অনায়াসেই পুরে রাখা যায়। অথচ এই বিপুল দেহ নিয়ে গ্রহরাজকে লাটিমের মতো ঘোরপাক খেতে হচ্ছে। এ কাজটি করতে পৃথিবীর চব্বিশ ঘণ্টা সময় লাগে, কিন্তু বৃহস্পতির দশ ঘণ্টাও লাগে না। বৃহস্পতির চারিদিকে সাতআটটি চাঁদ-তার মধ্যে চারটি বেশ বড়ো-বড়ো—তিনটি আমাদের চাঁদের চাইতেও বড়ো।

 বৃহস্পতির এলাকা পার হয়েছি। শনির আলো ক্রমে আরো উজ্জ্বল হয়ে আসছে।

নানা নিবন্ধ
২৪৭