পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আহ্লাদী মিনার

 মানুষ যখন ঘরবাড়ি তৈরি করে, তখন যত্ন করে মাটাম ধরে দেখে, বাড়ির দেয়ালটেয়াল সব ঠিক খাড়াভাবে গাঁথা হচ্ছে কিনা। তুমি যদি কাত করে তোমার বাড়ি বানাও তবে লোকে হয় তোমাকে পাগল বলবে, নাহয় ভাববে লোকটা আনাড়ি। অনেক পুরানো বাড়ি আছে যার দেয়ালগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে, বাড়ি আর এখন খাড়া নেই,—একদিকে হেলে পড়েছে। বেশি কাত হয়ে গেলে সে বাড়ি ভেঙে ফেলতে হয়। তা না হলে সেটা কোনো দিন আপনা থেকে ঘাড়ের উপর ভেঙে পড়তে পারে।

 কিন্তু ইটালির পিসা শহরে একটি প্রকাণ্ড মিনার বা স্তম্ভ আছে, সেটা এমন কাতভাবে তৈরি যে দেখলে মনে হয়,—এই বুঝি হুড়্‌মুড়্ করে সব আছাড় খেয়ে পড়ল। অথচ আটশো বছর ধরে সে এইরকম আহ্লাদীর মতো হেলেই আছে—তার পড়বার কোনো মতলব আছে বলে মনে হয় না। মিনারের আশেপাশে তার সমবয়সী কত যে বাড়ি ভেঙেচুরে লোপ পেয়ে গেছে, তার আর সংখ্যা নাই। ভেনিস শহরের লোকেরা একটা চমৎকার স্তম্ভ বানিয়েছিল; তাই দেখে তাদের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্যই পিসার লোকেরা এই স্তম্ভটি বানায়। ভেনিসের স্তম্ভটি কয়েক বৎসর হল ভেঙে পড়ে গেছে কিন্তু এটি এখনো বেশ চমৎকার অবস্থায় আছে—ভাঙবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এই হেলানো মিনারটির উপর থেকে মাটাম ঝোলালে দেখা যায় যে, তার চুড়োটা প্রায় তেরো ফুট হেলে পড়েছে! এমন অদ্ভুত বাঁকা স্তম্ভ বা দালান পৃথিবীর আর কোথাও নাই।

 মিনারটি যখন তৈরি করতে আরম্ভ করা হয়, তখন অবশ্য তাকে খাড়া করে বানাবারই কথা ছিল; কিন্তু খানিকটা তৈরি হবার পর একদিকের মাটি বসে যাওয়ায় খাড়া দালান কাত হয়ে পড়ল। তখন কেউ কেউ বললেন, “এখানে দালান তোলা চলবে না—ভালো জমি দেখে আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে।” কিন্তু অনেক আলোচনার পর শেষটায় স্থির হল যে, ঐরকম ট্যারচা ভাবেই স্তম্ভ তৈরি করা হবে। হরেকরকম খাড়া মিনার তো সব দেশেই আছে। কিন্তু পিসার এমন একটি স্তম্ভ হবে যেমনটি আর কোথাও নাই।” বড়ো-বড়ো রাজমিস্ত্রী সর্দারেরা বলল, “হাঁ ঐরকম কাত করেই আমরা মিনার স্তম্ভ বানিয়ে দেব।” এমন কায়দায় আগাগোড়া হিসাব করে মিনার গাঁখা হয়েছে যে তার সমস্তটা ভার স্তম্ভের ভিতর দিকেই পড়েছে। মিনারটা দেখতে যতই পড়ো পড়ো গোছের মনে হোক না কেন, বাস্তবিক পড়বার দিকে তার কোনো ঝুঁকি নাই।

 মিনারটি দেখতেও অতি সুন্দর,—তার আগাগোড়া মার্বেল পাথরে ঢাকা। প্রতি বৎসর নানা দূর দেশ থেকে বহু লোকে এই স্তম্ভ দেখবার জন্য পিসা শহরে যায়। পিসা শহরটি আরো নানা কারণে প্রসিদ্ধ। এই শহরে বিজ্ঞানবীর মহাপণ্ডিত গ্যালিলিওর জন্ম হয়। সে প্রায় তিনশো বৎসর আগেকার কথা। এই গ্যালিলিওই বলেছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এবং তার জন্য সেকালের মূর্খ পাদরিদের হাতে তাঁকে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল।

২৭৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২