পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আশ্চর্য প্রহরী

 বড়ো-বড়ো রাজারাজড়া বা লাট-বেলাট যখন সমারোহ করে বেড়াতে বেরোন তখন তাদের সঙ্গে কতগুলি 'বডি-গার্ড’ বা ‘শরীর-রক্ষক’ ঘোড়ায় চড়ে যায়। তারা যখন নিশান উড়িয়ে বাহার দিয়ে চলে, তখন দেখতে বেশ জমকাল দেখায়। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, এ ছাড়া তাদের আর বিশেষ কিছু কাজ করবার থাকে না। বছরের পর বছর কেটে যায়। কিন্তু কারও শরীর রক্ষা করবার জন্য তাদের কোনো ডাক পড়ে না।

 আমাদের শরীরে কোথায় কি হচ্ছে তাই নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেন তাঁরা বলেন, তুমি আমি রাম শ্যাম সকলের সঙ্গেই—এরকম দু-দশটা নয়, একেবারে লাখে লাখে-‘বডি-গার্ড’ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনরাত তার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে, দিনরাত ছুটোছুটি করে পাহারা দিচ্ছে, শত্রুর সঙ্গে লড়াই করবার জন্য দিনরাত প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। শত্রু ধরবার জন্য এত ব্যস্ততা কেন? এত শক্রই-বা কোথায়? শত্রু চারিদিকেই। আকাশে বাতাসে রোগের বীজ সব কিল্‌বিল্ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা নিশ্বাসের সঙ্গে নাক দিয়ে, গলা দিয়ে একেবারে ফুস্‌ফুসের ভিতর পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে, আর কতরকম জ্বরজারি সর্দিকাশির হাঙ্গামা বাধাচ্ছে। জলের সঙ্গে, দুধের সঙ্গে, নানারকম খাবারের সঙ্গে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগের বীজ শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। কোথায় একটু ঘা হলে বা কেটে গেলে সেই ফাঁক দিয়ে কত সাংঘাতিক ব্যারামের বীজ অনায়াসে ভিতরে ঢুকে অনর্থ বাধাবার চেষ্টা করছে। যদি বাঁচতে হয় তা হলে এই-সমস্ত শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখা দরকার। তাই, ধুলিকণার চাইতে সূক্ষ যে শত্রু, যাকে দেখতে হলে অণুবীক্ষণ লাগাতে হয়, তার সঙ্গে সারাদিন লড়াই করবার জন্য শরীরের মধ্যে আশ্চির্যরকম সূক্ষা ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 আমাদের শরীরটা এমনভাবে তৈরি যে তার যেখানেই কাটো সেখানেই রক্ত বেরোয়। কোথাও একটা ছুঁচের সমান সরু জায়গা খুঁজে পাবে না যার মধ্যে খোঁচা দিলে রক্ত গড়ায় না। শরীরে যতক্ষণ প্রাণ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত রক্তটা ক্রমাগত শরীরময় ছুটোছুটি করে বেড়ায়। তাও এলোমেলোভাবে ছুটবার হুকুম নাই। ঠিক তালে তালে, সারাদিন সারা বছর সারা জীবন তাকে পথ ধরে ধরে চলতে হয়-এক মুহর্ত বিশ্রাম করবার উপায় নাই। এইভাবে সর্বদা তাকে চালাবার জন্য শরীরের মধ্যে আশ্চর্য ‘পাম্পকল' বসানো আছে। বুকের মাঝখানে যে জায়গাটা সর্বদা ধুক্‌ধুক্ করে, যাকে আমরা হার্ট বা হৃৎপিণ্ড বলি, সেইটে হচ্ছে আমাদের পাম্পকল।

 ঘরে ঘরে কলের জল পেতে হলে তার জন্য শহরের এক-এক জায়গায় স্টেশন করে প্রকাণ্ড কলকারখানা বসাতে হয়। সেই স্টেশনের সঙ্গে বড়ো-বড়ো ‘পাইপ’ জুড়ে শহরময় জল চালাবার ব্যবস্থা করতে হয়; তার পর সেই মোটা পাইপের গায়ে সরু মোটা মাঝারি নানারকম নল লাগিয়ে ঘরে ঘরে জল আনতে হয়। শরীরের রক্ত চলবার ব্যবস্থাটাও অনেকটা এইরকমের। হৃৎপিণ্ডটা হল আমাদের কলের স্টেশন। শরীরের মোটা মোটা শিরাগুলি

নানা নিবন্ধ
২৮৩