পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাদের নাগাল পৌঁছায় না, তাই তারা কেবল রাগের মাথায় ফোঁস ফোঁস্ করছে। আর গাছের গোড়ায় ঢু মারছে। মাঝে মাঝে এক-একটা লাফ দিয়ে জাগুয়ারটাকে গুতো লাগাবার চেষ্টা করছে। কয়েকটা গাছে উঠতে গিয়ে বার বার পড়ে যাচ্ছে, তবু ছাড়ছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এইরকম থেকে জাগুয়ারটার বোধ হয় একটু পরিশ্রম হয়েছিল। সে যেই একটু নড়ে বসতে গেছে, অমনি তার একটা পা হড়কিয়ে ঝুলে পড়েছে। যেমন ঝোলা অমনি একটা পেকারি গিয়ে তার দাঁত দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিয়েছে। জাগুয়ারটাও একেবারে ক্ষেপে গিয়ে, এক লাফে পেকারিগুলোকে ডিঙিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু পড়ে আর তাকে উঠতে হল না, মাটিতে ঠেকার সঙ্গে সঙ্গে পেকারির পাল তার উপর পড়ে, তাকে মাড়িয়ে খেলিয়ে গুঁতিয়ে আঁচড়িয়ে কামড়িয়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। জাওয়ারটা যতক্ষণ বেঁচেছিল, ততক্ষণ সে ধস্তাধস্তি করতে ছাড়ে নি। কিন্তু তার উপরে এতগুলো শুয়োর চেপেছিল যে, মাটিতে পড়বার পর আর তাকে চোখেই দেখা যায় নি। শুয়োরগুলি যদি তাকে আর কিছু নাও করত, তবু শুধু চাপের চোটেই মেরে ফেলতে পারত। জাগুয়ারটা মরে যাবার পরেও পেকারিদের রাগ থামে নি। তারা প্রায় আধঘণ্টা পর্যন্ত, থেকে থেকে পাগলের মতো তার উপর তেড়ে যাচ্ছিল। তার পর যখন পেকারির দল চলে গেল তখন দেখা গেল এগারোটা পেকারি মরে পড়ে আছে, আর জাগুয়ারের রক্ত চামড়া মাংস আর হাড় চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে।

 পেকারিরা যখন শত্রুর সামনে পড়ে, তখন তারা ধনুকের মতো গোল হয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। যদি শত্রু আপনা থেকে সরে পড়ে তবে ভালোই। কিন্তু সে যদি একটুও তেজ দেখাতে চেষ্টা করে, তবে আর রক্ষা নেই। দলকে দল তার উপর পড়ে তাকে আর আস্ত রাখবে না। সেইজন্যে জাগুয়ারেরা কখনো ইচ্ছা করে পেকারির দলকে ঘাটাতে চায় না; অথচ পেকারির মাংস তার অতি প্রিয় খাদ্য। জাগুয়ার সাধারণত গাছের উপর পাতার আড়ালে চুপচাপ লুকিয়ে থাকে। যদি দৈবাৎ এক-আধটা পেকারি দল থেকে একটু এদিকে ওদিকে গিয়ে পড়ে সে এক লাফে তার ঘাড় ভেঙে আবার দৌড়ে গাছের উপর উঠে বসে, সেই সঙ্গে পেকারির দলও একেবারে চীৎকার করতে করতে সেই গাছের চারিদিকে এসে জড়ো হয়। জাগুয়ার ততক্ষণে বেশ একটি উঁচু ডালের উপর হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করতে থাকে। পেকারির দল সারাদিন কেবল চীৎকার আর দাপাদাপি করুক, তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। যখন তারা চলে যাবে, তখন সেও সুযোগ বুঝে সেই আগের মারা পেকারিটাকে খেতে নামবে।

 অনেক সময়ে নদীর ধারে কাদার মধ্যে গাছের গুড়ির উপর পেকারির দল হুড়াহুড়ি করে খেলে বেড়ায়। সেইখানে কাদামাখা কাঠের চেলার মতো কুমির হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে থাকে। সে আবার আমাদের দেশের কুমিরের চাইতেও চটপটে-এই দেখছ মড়ার মতো, এর পরেই হয়তো দেখবে পাঁচ হাত লাফ দিয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পেকারির দল এদিক-ওদিক ঘুরেটুরে যখন সেইদিকে অসে, কুমিরও ল্যাজটিকে টান করে ভাবে ‘এইবার সময় এসেছে'। যদি দৈবাৎ এক-আধটা পেকারি খেলতে খেলতে সেই ল্যাজের উপর উঠে পড়ে, তবে আর রক্ষা নেই। নিশ্চয় দেখবে, তার পরের মুহর্তেই ল্যাজের এক ঝাপটায় পেকারিভায়া ডিগবাজি খেয়ে শুন্যে উঠেছেন, তার পর শুন্যে থাকতে থাকতেই ৩০৪

৩০৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২