পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাইয়াছে। সকলে কিন্তু একেবারে লোপ পায় নাই। যদি পাইত তবে এখন পৃথিবীতে এ-সব জীবজন্তুর কিছুই দেখিতাম না। এখনকার এই-সকল জানোয়ারগুলি সকলেই প্রাচীনকালের কোনো-না-কোনো জানোয়ারের বংশধর। এই যে অতি সভ্য অতি বুদ্ধিমান মানুষ, ইহার বংশের ইতিহাস যদি খুঁজিতে যাই তবে এমন জায়গায় গিয়া পড়িব যেখানে মানুষকে আর মানুষ বলিয়া চিনিবার জো থাকিবে না।

 এমনিভাবে প্রত্যেক জানোয়ারের ইতিহাস যদি খুঁজিতে যাই—প্রাচীনকালের পাহাড়ের স্তরে তাহাদের যে-সকল কংকালচিহ্ন পাওয়া যায়, সে-সকল যদি পরীক্ষা করিয়া দেখি— তবে প্রত্যেকের বেলায় এই কথারই প্রমাণ পাওয়া যাইবে। কিন্তু যে-সকল জানোয়ার ছিল, তাহারা সকলেই তো আর আপন আপন কংকালচিহ্ন রাখিয়া যায় নাই- যে-সকল কংকাল পাহাড়ের মধ্যে আজও জমিয়া আছে, তাহারও অতি অল্পই মানুষের চোখে পড়িয়াছে। সেই সকল জন্তুর পূর্বপুরুষের হিসাব এখনো ভালো করিয়া পাওয়া যায় নাই। দুটা-একটা যাহা পাওয়া যায়, তাহা হইতেই কতকটা স্পষ্ট দেখা যায়, কতকটা অনুমান করিয়া বুঝিতে হয়, কেমন করিয়া অল্পে অল্পে সেই যুগের এক-একটা জানোয়ার এই যুগের কুকুর বেড়াল গোরু হরিণে পরিণত হইয়াছে। পুরাতন কংকাল হইতে যত জানোয়ার-বংশের প্রাচীন ইতিহাস পাওয়া গিয়াছে, তাহার মধ্যে ঘোড়ার ইতিহাস আমরা যেমন জানি এমন আর কাহারও নহে। আমেরিকার ‘রকি’ পাহাড়ে অনেক জানোয়ারের কংকালচিহ্ন পাওয়া যায়। কয়েকজন পণ্ডিত চৌদ্দ বৎসর ক্রমাগত সন্ধান করিয়া সেখানে নানা প্রাচীন যুগের প্রায় আটশত ঘোড়ার কংকাল বাহির করিয়াছেন। ‘ঘোড়া’ বলিলাম বটে কিন্তু তাহার অনেক গুলিকেই সহজে ঘোড়া বলিয়া চিনিবার জো নাই।

 সবচাইতে পুরাতন যেটি, তাহার নাম ‘ইয়েহিপপাস (Eohippus) বা ‘আদি অশ্ব'। দেখিতে একটি ছোটো ছাগলছানার চাইতে বড়ো হইবে না—পায়ে তার চারটি করিয়া আঙুল বা খুর—আর একটা পঞ্চম আঙুলের চিহ্নপ্রায় লোপ পাইয়া আসিয়াছে। দেখিলে কে বলিবে যে এই জন্তই ঘোড়ার পূর্বপুরুষ? কিন্তু সবগুলি কংকাল মিলাইয়া যুগ হিসাবে পর পর সাজাইয়া দেখ, ঘোড়ার জন্মের ইতিহাস যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখিতে পাইবে। ছাগলছানার মতো ছোটো জন্তুটি কেমন করিয়া যুগের পর যুগ ক্রমে বড়ো হইল, কেমন করিয়া ক্রমে তাহার চেহারা অল্পে অল্পে বদলাইয়া আসিল, কেমন করিয়া নিত্য নূতন অবস্থার মধ্যে তাহার শরীরের নিত্য নুতন পরিবর্তন ঘটিতে ঘটিতে সেই যুগের ‘আদি অশ্ব' এই যুগের আধুনিক ঘোড়ায় পরিণত হইল, তাহার জীবন্ত চিত্র পাথরের গায়ে কংকালের লেখায় লিখিত রহিয়াছে।

 বড়ো হইবার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পায়ের গড়ন মজবুত হইয়া আসিয়াছে—তাহার সমস্ত শরীরটা দ্রুত দৌড়িবার উপযোগী হইয়াছে। যে দৌড়াদৌড়ি করে, যাহাকে পরিশ্রম করিতে হয়, তাহার পক্ষে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করা আবশ্যক হয়। সতরাং দেহের শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমাণ খাদ্য চিবাইবার উপযোগী দাঁত তাহার থাকা চাই। তাহার চোয়ালের হাড়ও ক্রমে সেইরূপ মজবুত হওয়া দরকার। এই-সকল কংকালের দাঁত ও মাথার হাড় পরীক্ষা করিলেও ঠিক এই কথারই প্রমাণ পাওয়া যায়।

৩১৬
সুকুশল সমগ্র রচনাবলী : ২