পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গরিলার লড়াই

 যতরকম বনমানুষ আছে তার মধ্যে, বুদ্ধিতে না হোক, শরীরের বলে গরিলাই সেরা। হাত-পায়ের মাংসপেশীর বাঁধন থেকে তার দাঁড়াবার ধরন আর ভ্রুকুটিভঙ্গি পর্যন্ত সবই যেন খাঁ খাঁ করে তেড়ে বলছে, “খবরদার! কাছে এসো না।”

 মানুষের মধ্যে এত বড়ো পালোয়ান কেউ নাই, যে এক মিনিটের জন্যেও একটা গরিলার রোখ সামলাতে পারে। কিন্তু গরিলায় গরিলায় যদি লড়াই লাগে, তা হলে সেটা দেখতে কেমন হয়? বড়ো-বড়ো পালোয়ান কুস্তিগীরের লড়াই দেখতে কত মানুষ পয়সা দিয়ে টিকিট কেনে। সে লড়াই যতই ভীষণ হয়, হুড়াহুড়ি ধস্তাধস্তি যতই বেশি হয়, মানুষের ততই উৎসাহ বাড়ে। কিন্তু গরিলাদের মধ্যেও কি সেরকম লড়াই বা রেষারেষি লাগে? লাগে বৈকি। এমন গরিলা পাওয়া গিয়েছে যার দাঁত ভাঙা বা কানটা ছেঁড়া, অথবা গায়ে মাথায় অন্য গরিলার দাঁতের চিহ্ন রয়েছে। লড়াইয়ের সময় কোনো মানুষ উপস্থিত থেকে তা দেখেছে, আজ পর্যন্ত এরকম শোনা যায় নি-কিন্তু মাঝে মাঝে এরকম লড়াই যে হয়, নানারকম গর্জন আর হুংকার আর বুক চাপড়াবার গুন্ গুন্ শব্দে অনেক সময় তার পরিচয় পাওয়া যায়। গরিলা যখন ক্ষ্যাপে, তখন রাগে সে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় আর আপনার বুকে দমাদম্ কিল মারতে থাকে। তার চোখ দুটো তখন আগুনের মতো জ্বলজ্বল করে, তার কপালের লোম ফুলে ফুলে খাড়া হয়ে উঠে আর সেই সঙ্গে নাকের ফঁস্ ফঁস্ আর দাঁতের কড়্‌মড়্ শব্দ চলতে থাকে। তার উপর সে যখন হুংকার ছাড়ে, তখন অতি বড়ো সাহসী জম্ভও পালাবার পথ খুঁজতে চায়। লোকে বলে, সে হুংকার নাকি সিংহের ডাকের চাইতেও ভয়ানক।

 মনে করো, জঙ্গলের মধ্যে কোনো গরিদাসুন্দরীর বিয়ের জন্য দুই মহাবীর পাত্র এসেছেন। দুজনেই তাকে ভালোবাসে, দুজনেই তাকে চায়, কেউ দাবি ছাড়তে রাজি নয়। এমন অবস্থায় পশুপাখির মধ্যে সর্বত্রই যা হয়ে থাকে, আর পুরাণের বড়ো-বড়ো স্বয়ংবর সভাতেও যেমন হয়ে এসেছে, এখানেও ঠিক তাই হওয়াই স্বাভাবিক। তখন দুই বীর আপন আপন তেজ দেখিয়ে লড়াই করতে লেগে যায়। সে ভীষণ লড়াই যে একটা দেখবার মতো ব্যাপার তাতে আর সন্দেহ কি? গরিলার চড় আর গরিলার ঘুষি, যার একটি মারলে মানুষের ভুড়ি ফেসে যায়, মাথার খুলি দু ফাঁক হয়ে যায়, সে কেবল গরিলার গায়েই সয়। সেই চটপট দুমদুম্ কিল চড়ের সঙ্গে খামচা-খাচি আর কামড়া-কামড়িও নিশ্চয়ই চলে। এইরকমে যতক্ষণ না লড়াইয়ের মীমাংসা হয়, অর্থাৎ যতক্ষণ একপক্ষ হার মেনে চম্পট না দেয়, ততক্ষণ হয়তো গরিলাসুন্দরীর চোখের সামনেই এক ভীষণ কাণ্ড চলতে থাকে। সে বেচারা হয়তো চুপ করে তামাশা দেখে, কিম্বা দুজনের মধ্যে কাউকে যদি তার বেশি পছন্দ হয়, তবে তার পক্ষ হয়ে লড়াইয়ে একটু-আধটু যোগ দেওয়াও তার কিছু আশ্চর্য নয়।

সন্দেশ-মাঘ, ১৩২৪
৩২৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২