পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কোনো কোনো সজারু খুব চট্‌পট্ গাছে চড়তে পারে, তাদের ল্যাজ প্রায়ই খুব লম্বা হয়। আবার কোনো কোনোটার কাঁটা বড়ো-বড়ো লোমে ঢাকা।

 কাঁটাওয়ালা জন্তু আরো অনেক আছে, কিন্তু সজারুর মতো এমন কাঁটার বাহার আর কারও নেই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার একিড্‌না (Echidna) জন্তুটির একটুখানি চেহারা দেখলেই বুঝতে পারবে যে, এমন অদ্ভুত জানোয়ার সম্বন্ধে দু-একটা কথা না বললে নিতান্তই অন্যায় হবে। সাধারণ একিড্‌নাগুলি বেড়ালের চাইতে বড়ো হয় না; কিন্তু 'ধাড়ি একিড্‌না' বা Proechidna আরো অনেকখানি বড়ো হয়—বেশ একটি ছোটোখাটো ভাল্লুকের মতো। অস্ট্রেলিয়ার প্লেটিপাস (Platypus) বা হংসচঞ্চুর মতো এরাও স্তন্যপায়ী অথচ ডিম পাড়ে ডিম ফুটে যে ছানা বেরোয় তারা মায়ের দুধ খায়। এই জন্তুর শরীরটি ছোটো ছোটো কাঁটায় ভরা-ছোটো-ছোটো কিন্তু খুব শক্ত আর ধারালো মুখখানা ওরকম অদ্ভুত ছুঁচালো হবার কারণ এই যে, এরা পিঁপড়ে-খোর। চোঙার মতো মুখ, তার মধ্যে একটিও দাঁত নাই —আছে খালি একটি প্রকাণ্ড সরু লম্বা জিভ: তাই দিয়ে সে লক্‌লক্ করে পিঁপড়ে চেটে খায়! সজারুর মতো এরাও নিশাচর-তাই দিনের বেলায় গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে থাকে।

 পিপড়ে-খোর জন্তুদের অনেকেরই মুখ ঐ চোঙার মতো কিন্তু সকলের গায়ে বর্ম নাই। যাদের গায়ে বর্ম আছে তাদের নাম প্যাঙ্গোলিন (Pangolin)। এই জন্তুর বর্মের গড়ন ভারি অদ্ভুত। শিঙের মতো মজবুত চাকতি, সমস্তটি গায়ের উপর মাছের আঁশের মতো সাজানো। পায়ের নখগুলি সাংঘাতিক মজবুত - তাই দিয়ে আঁচড়িয়ে তারা উইয়ের ঢিপি আর পিঁপডের বাসা ভেঙে ফাঁক করে ফেলে। তার পর জিভ দিয়ে টপাটপ উই পিপড়ে চেটে খায়। হঠাৎ তাড়া করলে বা ভয় পেলে এরা ডিগবাজি খেয়ে ফুটবলের মতো গোল পাকিয়ে যায়। এদের গায়ের ধারালো আঁশগুলি তখন চারিদিকে খাড়া হয়ে ওঠে। দক্ষিণ আমেরিকার আর্‌মাডিলো এ বিষয়ে আরো ওস্তাদ। সে যখন হাত-পা গুটিয়ে শরীরটিকে লাড়ু পাকিয়ে ফেলে তখন কোথায় মুখ কোথায় হাত-পা, কিছুই বুঝবার জো থাকে না। তার বর্মের গড়নটি মাছের আঁশের মতো নয়—চিংড়ি মাছের খোলার মতো।

 বর্মধারী জীবের কথা বলতে গেলে আরো অনেক জন্তুরই নাম করতে হয়। শামুক ঝিনুক প্রবাল হতে আরম্ভ করে কাঁকড়া চিংড়ি বিচ্ছু, এমন-কি, মাছ গিরগিটি পর্যন্ত প্রাণের দায়ে কত দেশে কতরকম বর্ম এঁটে ফেরে তার আর সীমা সংখ্যা নাই। হাজাররকম জীবজন্তু, তারা সবাই যখন বাঁচতে চায় তখন বাঁচবার উপায়ও তাদের করতে হয়। বাঁচবার উপায় তিনরকম। এক হচ্ছে গায়ের জোরে অস্ত্রেশস্ত্রে প্রবল হয়ে শত্রুকে মেরে বাঁচা। আর-এক হচ্ছে দৌড়ের জোরে বা কলা-কৌশলে পালিয়ে আর লুকিয়ে বাঁচা। আর তৃতীয়টি হচ্ছে শরীরটিকে এমন জবরদস্ত করা যে, মারধোর অত্যাচারের চোট সে সয়ে থাকতে পারে। বর্মধারী জীবেরা এই শেষ উপায়টিকে বাগাবার চেষ্টায় আছেন। এতে এক-একজন যে অনেকখানি ওস্তাদি দেখিয়েছেন তাতে সন্দেহ কি?

সন্দেশ -মাঘ, ১৩২৪
৩৩০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২