পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চায় না, সেইজন্য আমেরিকার একদল লোকে বক্তৃতা করিয়া, কাগজেপত্রে লিখিয়া, বায়োস্কোপে ছবি দেখাইয়া এ বিষয়ে মানুষের মনের বিরোধ ভাঙিতেছেন। আমেরিকার কোনো কোনো শহরে প্রকাশ্য বাজারে দশ-আনা সেরে তিমির মাংস বিক্রয় হইতেছে।

 গোরু ঘোড়া শুকর কিছুতেই যাহাদের আপত্তি নাই তাহার যে তিমি খাইতে বেশি দিন আপত্তি করিবে, এরূপ বোধ হয় না। যাঁহারা ইহার মধ্যেই ও জিনিসটা খাইতে অভ্যাস করিয়াছেন, তাহার বলেন—চমৎকার মাংস। ইউরোপের বাজারে ইহাকে গো-মাংস বলিয়া চালাইলেও কেহ কোনো তফাত বুঝিবে কিনা সন্দেহ।

 সবরকম তিমির মাংস খাইতে ভালো নয়। যেগুলি বিশেষভাবে খাওয়ার উপযোগী সেগুলি সাধারণ ছোটোখাটো তিমি-অর্থাৎ মোটে কুড়ি-পঁচিশ হাত লম্বা। মোম তিমি বা sperm whale লম্বায় খুব বড়ো হয়—এক-একটা ষাট হাত পর্যন্ত দেখা গিয়াছে। সব চাইতে বড় যে তিমি সেগুলি থাকে একেবারে উত্তরে, মেরু সমুদ্রের কাছে—তাহারা লম্বায় মোম তিমির সমান, কিন্তু অনেকখানি চওড়া ও মোটা এবং ওজনেও প্রায় দেড়। একএকটি বড়ো তিমির ওজন চারহাজার মণেরও বেশি হয়—অর্থাৎ ত্রিশ-চল্লিশটা বড়ো-বড়ো হাতির সমান। এই-সমস্ত অতিকায় তিমি আগে সমুদ্রের মধ্যে অনেক দেখা যাইত, কিন্তু মানুষের অত্যাচারে ইহাদের বংশ ক্রমে প্রায় উজাড় হইয়া আসিতেছে।

 তিমি নানারকমের হয়—তাহাদের মোটের উপর দুই দলে ভাগ করা যায়। এক দলের দাঁত নাই, আর এক দলের দাঁত আছে। যেগুলীর দাঁত নাই তাহাদের মুখের ভিতরে প্রকাণ্ড চিরুনির ঝালরের মতো একটা জিনিস থাকে, তাহাকে বলে কাঁচকড়া বা whale bone এই জিনিসটা মানুষের অনেক শৌখিন কাজে লাগে এবং বাজারে বিক্রয় করিলে বেশ দামও পাওয়া যায়। তা ছাড়া এক-একটা তিমির গায়ে যে পরিমাণ তেল বা চর্বি থাকে তাহার দামও বড়ো সামান্য নয়। যে মোম তিমির কথা আগে বলিয়াছি তাহার মুখে কাঁচকড়া নাই কিন্তু তাহার মাথার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড চৌবাচ্চা ভরা মোম থাকে। এই মোমের চমৎকার বাতি হয় এবং নানারকম মলম প্রভৃতি হয়। এই মোম চবি ও কাঁচকড়ার জন্য মানুষে সমুদ্রের নানা স্থানে বড়ো-বড়ো তিমিগুলিকে নিঃশেষ করিয়া এখন ছোটোখাটো তিমির পিছনে লাগিয়াছে।

 যে-সব 'ছোটোখাটো’ তিমির কথা বলা হইল, তাহাদের এক-একটাকে মারিলে প্রায় তিন-চারশত মণ মাংস পাওয়া যায়। অজিকাল তিমির ব্যবসা অনেক কমিয়া গিয়াছে, কিন্তু তবু গত দুই বৎসরে কেবল উত্তর আমেরিকায় প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলেই বারোশতের বেশি তিমি মারা হইয়াছে। এখন এ ব্যবসায়ে আরো লাভ হইবার কথা, কারণ এখন হইতে তিমির হাড় মাংস চর্বি চামড়া সমস্তই কাজে লাগানো চলিবে। এতকাল চর্বি ও কাঁচকড়া বাহির করিবার পর অত বড়ো প্রকাণ্ড দেহটাকে সমুদ্রে ফেলিয়া দেওয়া হইত তাহাতে কেবল হাজার হাজার জলজন্তুর খোরাক জুটিত। কিন্তু এখন সেই মাংসে মানুষের উদরপূর্তি হইবে। এইরূপ একটা তিমিকে মারিলে স্বচ্ছন্দে বিশ-ত্রিশ হাজার লোকের ভোজের আয়োজন হইতে পারে। তার পর কংকালটুকুও ফেলিবার জিনিস নয়—তাহাকে পোড়াইয়া চমৎকার জমির সার ও নানারকম ঔষধ তৈয়ারি হইবে। চামড়াটায় চর্বি ভরা

৩৪৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলীঃ ২