পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আলিপুরের বাগানে

 আলিপুরের চিড়িয়াখানায় আমাদের একটি বন্ধু আছেন। আমরা যখনই আলিপুর যাই অন্তত একটিবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ভুলি না। দেখা করবার সময় শুধু হাতে যাওয়াটা ভালো নয়, তাই বন্ধুর জন্য প্রায়ই কিছু উপহার নিয়ে যাই। তিনিও তাঁর সাধ্যমত নানারকম তামাশা কসরত ও মুখভঙ্গি দেখিয়ে আমাদের আপ্যায়িত করেন।

 অনেকে চিড়িয়াখানায় গিয়ে গোড়া থেকেই বাঘের ঘরটা দেখবার জন্য ব্যস্ত হন। সাপ, কুমির, উটপাখি, গণ্ডার আর হিপোপটেমাস—কেউ কেউ এদেরও খুব খাতির করে থাকেন। কিন্তু যে যাই বলো বাগানে ঢুকতে না ঢুকতেই আমাদের মনটা সকলের আগে বলতে থাকে, বন্ধুর বাড়ি চল্, বন্ধুর বাড়ি চল্। বন্ধুর সঙ্গে কেন যে আমাদের এত ভাব, তা যদি শুনতে চাও, তা হলে তাঁর নামের পরিচয়, গুণের পরিচয়, বিদ্যার পরিচয়, সব তোমাদের শুনতে হয়।

 বন্ধুটির নাম হচ্ছে শ্রীযুক্ত ওরাংচন্দ্র ওটান। আফ্রিকা নিবাসী, আলিপুর প্রবাসী। অমন অমায়িক চেহারা, অমন ঢিলেঢালা প্রশান্ত স্বভাব অমন ধীর গম্ভীর মেজাজী চাল, সমস্ত আলিপুর খুঁজে আর কোথাও দেখবে না।

 কত যে ভাবনা আর কত যে হিসাপত্র সর্বদা তাঁর মাথার মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে, তাঁর ঐ প্রকাণ্ড কপালজোড়া হিজিবিজি রেখাগুলো দেখলেই তা বুঝতে পারবে। যখন তিনি চিৎপাত হয়ে শুয়ে, মুখের মধ্যে আঙুল দিয়ে, পেট চুলকাতে থাকেন, আর তাঁর কালো কালো হ্যাংলা মতন চোখ-দুটি মিটমিট করে তাকিয়ে থাকে, তখন যদি তার মনের মধ্যে কান পেতে শুনতে পারতে, তা হলে শুনতে সেখানে অনর্গল হিসাব চলছে—“আর চারটে কলা, আর দু ঠোঙা বাদাম আর কতগুলো বিস্কুট, আর ঐ নাম-জানি না গোল-গোল-মতন অনেকখানি —ইত্যাদি। যখন তিনি খাঁচার ছাত থেকে গরাদ ধরে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো ঝুলতে থাকেন আর দুলতে থাকেন—যেন সংসারের কোনো কিছুতে তাঁর মন নেই—তখন যদি তাঁর মনের কথা শুনতে, তা হলে শুনতে পেতে, তিনি কেবলই ভাবছেন, কেবলই ভাবছেন, এই লোকটার পাগড়ি নাহয় ঐ লোকটার চাদর, নাহয় এই সাহেবটার টুপি, নাহয় ঐ বাবুটার ছাতা-নেবই নেব, নেবই নেব।’

 একদিন আমরা চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখি, ওরাংবাবু দোলনা বেঁধে দোল খাচ্ছেন। কোখেকে কি করে, কার একটা পাগড়ি তিনি আদায় করেছেন, আর সেইটাকে ছাতের গরাদের উপর থেকে ঝুলিয়ে অপূর্ব দোলনা তৈরি হয়েছে। তিনি দুহাতে তার দুই মাথা ধরে মনের আনন্দে দুলছেন। তাঁর মুখখানা যেন সদানন্দ শিশুর মতো, নিজের বাহাদুরি দেখে নিজেই অবাক।

 হঠাৎ তার কি খেয়াল হল, পাগড়ির একটা দিক ছেড়ে দিয়ে তিনি গেলেন মাথা চুলকোতে। অমনি পাগড়ির একটা মাথা ভারী হয়ে নেমে পড়ল, আর আরেক মাথা আলগা পেয়ে সুড়ৎ করে গরাদের উপর দিয়ে ছিলে বেরিয়ে এল। ব্যাপারখানা বুঝবার আগেই ওরাংবাবু

জীবজন্তুর কথা
৩৫৯