পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কাঁটাচুয়ার সারা গায়ে কাঁটা, তার গায়ে কোথাও কামড় দেবার জো নাই। কিন্তু তার গলার নীচটাতে কাটা নাই, সেখানে কামড় দিলে বেচারা আর আত্মরক্ষা করতে পারে না। ইদুরেরা তাই সুযোগ বুঝে তার গলায় কামড় বসাবার চেষ্টা করে। ভুলেও কখনো পিঠের উপর কামড় দিতে যায় না। বেজি যখন সাপের সঙ্গে লড়াই করে তখন তার দৃষ্টি থাকে সাপের ঘাড়ের কাছে, ঠিক ফণাটির পিছনে। সেখানে কামড় দিয়ে ধরলে সাপ আর উলটে ছোবল মারতে পারে না।

 ছোটো-ছোটো পোকামাকড়েরা পর্যন্ত এই-সব সংকেত জানে। তোমরা বোলতা আর মাকড়সার লড়াই দেখেছ? সে এক অদ্ভুত জিমিস। মাকড়সা জানে যে বোলতার একটি কামড় খেলে তার আর রক্ষা নাই, তাই সে কেবলই জালের আড়াল দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। সেই জালের ভিতর থেকে সবগুলি পা একসঙ্গে বার করে সে বোলতাকে ভয় দেখবার চেষ্টা করে, কিন্তু কখনো তেড়ে গিয়ে আক্রমণ করবার সাহস পায় না। বোলতাও বার বার ভন্ভন্ করে জালের কাছ পর্যন্ত তেড়ে এসে আবার পালিয়ে যায়, কারণ সেও জানে যে ঐ জালের মধ্যে একবার আটকা পড়লে তার আর বের হবার উপায় নাই।

 কেবল যে অন্য জন্তুদের সঙ্গেই জানোয়ারদের লড়াই বাধে, তা নয়। ছাগলের লড়াই বেড়ালের ঝগড়া কিম্বা কুকুরের কামড়াকামড়ি তোমরা সকলেই দেখেছ। কাগে কাগে কিম্বা চড়াইয়ে চড়াইয়ে ঝগড়াও সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের ঘরে একটা ধাড়ি ঠিকটিকি আছে, সন্ধ্যার পর দেয়ালের বাতির কাছে, যে-সব পোকা বসে সে তাদের ধরে ধরে খায়। অন্য টিকটিকিকে ঘরের ত্রিসীমানার মধ্যে আসতে দেখলে সে তাকে তাড়া করে যায়, পাছে সে এসে তার খাবারে ভাগ বসায়। খাবারের জন্যে জানোয়ারদের মধ্যে রেষারেষি তো চলেই, বিয়ের জন্যেও রেষারেষি চলে। মনে কর জঙ্গলে একজন পরমাসুন্দরী গণ্ডারনী আছেন আর দুটি ছোকরা গণ্ডার আছে, তাদের দুজনেরই তাঁকে ভারি পছন্দ। এখন উপায়? উপায় হচ্ছে দস্তুরমতো লড়াই করে এর মীমাংসা করে নেওয়া। এরকম লড়াই হরিণদের মধ্যেও চলে, অন্যান্য অনেক জন্তুদের মধ্যেও চলে। পাখিদের মধ্যে তো খুবই চলে।

 এ ছাড়া এমন অনেক জন্তু আছে যারা কেবল লড়াইয়ের খাতিরেই লড়ে। যে-সব দলছাড়া হাতি একলা একলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, তাদের স্বভাবটা অনেক সময়েই এইরকম হয়। বুনো বরাহদের স্বভাবটাও নাকি অনেকটা এই ধরনের। আর-এক রকম ভিমরুলের কথা আমি জানি, সে থাকে খাসিয়া পাহাড়ে, তার গায়ে ডোরা ডোরা দাগ। তাকে কিছু না বললেও সে তেড়ে এসে বঁড়শির মতো হুল দিয়ে কামড় বসিয়ে দেয়। আমার মাথায় ভালো করে কামড়াতে পারে নি, তবু তিনদিন ব্যথার চোটে আমার ঘুমানো মুশকিল হয়েছিল।

সন্দেশ—অশ্বিন, ১৩২৯
৩৬৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২