পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাইরের কথা। আসল ভেতরের জিনিস যদি কিছু পেতে চান তবে তার একমাত্র উপায় হচ্ছে সমীক্ষা-সাধন । সকলের প্রস্থান দ্বিতীয় দৃশ্য সমীক্ষা মন্দির । অন্ধকার ঘরের মাঝখানে লাল বাতি, ধূপধুনা ইত্যাদি। কপালে চন্দন মাখিয়া ঈশান উপবিল্ট, তাহার পাশে একদিকে সোমপ্রকাশ ও জনাৰ্দন, অপরদিকে নিকুঞ্জ ও দুইটি শূন্য আসন ঈশানের সংগীত ও তৎসঙ্গে সকলের যোগদান ঈশান । দেখতে-দেখতে সব যেন নিস্তেজ হয়ে ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল । বোধ হল যেন ভেতরকার খণ্ড-খণ্ড ভাবগুলো সব আলগা হয়ে যাচ্ছে । যেন চারদিকে কি-একটা কাণ্ড হচ্ছে, সেটা ভেতরে হচ্ছে কি বাইরে হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না । কেবল মনে হচ্ছে, ঝাপসা ছায়ার মতো কে যেন আমার চারদিকে ঘুরছে । ঘুরছে-ঘুরছে আর মনের বাঁধন সব খুলে সত্যবাহন ও ভবদুলালের প্রবেশ ভবদুলাল। (সশব্দে খাতা ফেলিয়া মুখ মুছিতে-মুছিতে ) বস রে কি গরম ! সকলে । সূ-স্ব-স্ব-সৃ= ভবদুলাল । এখন সেই মক্ষিকা চক্র হবে বুঝি ? নিকুঞ্জ। এখন কথা বলবেন না—স্থির হয়ে বসুন । সোমপ্রকাশ । মক্ষিকা নয়—সমীক্ষা । ঈশান। অনেকক্ষণ চেয়ে তার পর ভয়ে ভয়ে বললাম, কে ? শুনলাম আমার বুকের ভিতর থেকে ক্ষীণ সরু গলায় কে যেন বললে, “আমি । বোধ হল যেন ছায়াটা চলতে-চলতে থেমে গেল। তখন সাহস করে আবাব বললাম, কে ? আমনি কে-কে-কে বলে কাপতে-কঁপিতে-কাপতে-কাপতে কে যেন সদর মতো সরে গেল—চেয়ে দেখলাম, আমিই সেই ছায়া, ঘুরছি-ঘুরছি আর বাঁধন খুলছে। জনাদন। মনের লাটাই ঘুরছে আর সুতো খুলছে, আণ আত্মা-ঘুড়ি উধাও হয়ে শূন্যে উড়ে গোৎ খাচ্ছে । সুশান । কালের স্লোতে উজান ঠেলে ঘুরতে-ঘুরতে ছি আর দেখছি যেন কাছের জিনিস সব ঝাপসা হয়ে সরে যাছে, আর দূরের জিনিসগুলো অন্ধকার করে ঘিরে আসছে। ভূত, ভবিষ্যৎ সব তাল পাকিয়ে জমে উঠেছে আর চারিদিক হতে একটা বিরাট অন্ধকার হা করে আমায় গিলতে আসছে। মনে হল একটা প্ৰকাণ্ড জঠরের মধ্যে অন্ধকারের জারকরসে অল্পে আর, আমায় জীর্ণ করে ফেলছে আর স্বটি প্রপঞ্চের শিরায় לפי আমি অল্পে আল্পে ছড়িয়ে পড়ছি। অন্ধকার যতই জমাট হয়ে উঠছে, ততই আমায় আস্তে আস্তে ঠেলছে আর বলছে, “আছ নাকি, আছ নাকি ? আমি প্রাণপণে চীৎকার করে বললাম, আছি । কিন্তু কোনো আওয়াজ হল না—খালি মনে হল অন্ধকারের পাঁজরের মধ্যে আমার শব্দটা নিশ্বাসের মতো উঠছে আর পড়ছে । ভবদুলাল। উঃ ! বলেন কি মশাই ? ঈশান । কোথাও আলো নেই, শব্দ নেই, কোনো স্থল নেই, বস্তু নেই—খালি একটা অন্ধপ্রাণের ঘূণি ঝড়ের বাঁধন ঠেলে-ঠেলে বুদ্ধদের মতো চারিদিকে ফুলে উঠছে। দেখলাম সৃস্টির কারখানায় মালপত্রের হিসেব মিলছে না। অন্ধকারের ডাজে ভাঁজে পঞ্চতন্মাল্লা সাজানো থাকে, এক জায়গায় তার কাচা মসলাগুলো ভূতগুদ্ধি না হতেই হুড়হড় করে স্থলপিণ্ডের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে বলতে গেলুম সর্বনাশ । সর্বনাশ ! সৃষ্টিতে ভেজাল পড়েছে- কিন্তু কথাগুলো মুখ থেকে বেরোল না। বেরোল খালি হা-হা-হা-হা একটা বিকট হাসির শব্দ । সেই শব্দে আমার সমীক্ষা-বন্ধন ছুটে গিয়ে সমস্ত শরীর ঝিম-ঝিম করতে লাগল । ভবদুলাল। আপনি চলে আসবার পর আমি দেখলাম সেই যে লোকটা ভেজাল দিয়েছে, সেই ভেজাল ক্ৰমাগত ঠেলে উপর দিকে উঠতে চাচ্ছে। উঠতে পারছে না, আর ওমরে-ওমরে কেঁপে উঠছে। আর কে যেন ফিস-ফিস করে বলছে—শেক দি বট্টল, শেক দি বট্‌ল –সত্যি । ঈশান ! কি মশাই আবোল তাবোল বকছেন । সোমপ্রকাশ। দেখুন, এ-সব বিষয়ে ফস করে কিছু বলতে নেই—আগে ডিতরে-ভিতরে ধারণা সঞ্চয় করতে হয়। জনাৰ্দন । হ্যা, সব জিনিসে কি আর মেকি চলে ? ভবদুলাল । ও, ঠিক হয় নি বুঝি ? তা আমার তো আভোস নেই—তার উপর ছেলেবেলা থেকেই কেমন মাথা খারাপ। সেই একবার পাগলা বেড়ালে কামড়েছিল, সেই থেকে ঐরকম । সে কিরকম হল জানেন ? আমার মেজোমামা, যিনি ভাগলপুরে চাকরি করেন, তার ঐ পশ্চিমের ঘরটায় টেপি, টেপির বাপ, টেপির মামা, মনোহর চাটুযো—না, মনোহর .য্য নয়-—মহেশ দী, ভোলা— ঈশান । তাহলে ঐ চলুক, আমি এখন উঠি । ডবদুলাল । শুনুন-না—সবাই বসে-বসে গল্প করছে এমন সময়ে আমরা ধর-ধর বলে বেড়ালটাকে তাড়া করে ঘরের মধ্যে নিতেই বেড়ালটা এক লাফে জানাদার উপর যেই না উঠেছে, অমনি আমি দৌড়ে গিয়ে খপ্‌ করে ধরেছি তার ল্যাজে—আর বেড়ালটা ফ্যাস করে আমার হাতের উপর কামড়ে দিয়েছে। ঈশানের প্রস্থানোদ্যম ভবদুলাল। এই একটু গুনে যান—গল্পটা ভারি মজার । ঈশান দেখুন, এটা হাসবার এবং গল্প করবার জায়গা নয়। Q সুকুমার সময় মোবলী । ৭