পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাদের মারধর করে বেঁধে নিয়ে যায়। লিভিংস্টোন এই-সব অত্যাচারের কথা শুনে একেবারে খেপে গেলেন। তিনি বললেন, যেমন করে হোক, এ অত্যাচার থামাতে হবে।

 তিনি দেখলেন, ব্যবসা করতে হলে সেই লোকদের এমন সব পথ দিয়ে যেতে হয়, যেখানে পর্তুগীজ আর আরবরা তাদের সহজেই ধরে ফেলতে পারে—সমুদ্রে যাওয়া আসার আর কোনো সহজ রাস্তা তাদের জানা ছিল না। তাদের দেশে বাণিজ্যের কোনো ভালো বন্দোবস্ত নাই। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় লোকদের মধ্যে ব্যবসা চালাবার কোনো সুযোগ নাই। লিভিংস্টোন তখন পথঘাটের সন্ধান করে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। বড়ো বড়ো নদীর পথ ধরে দিনের পর দিন চলে চলে, কত নতুন দেশ, নতুন পাহাড়, নতুন লোকের খবর পেলেন। এই কাজ তার এত ভালো লাগল আর তাতে তার এত উৎসাহ হল যে, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে, পাদরির কাজ ফেলে, এই কাজেই দিনরাত লেগে রইলেন।

 ক্রমে তিনি বুঝতে পারলেন, আফ্রিকার এপার ওপার পুব-পশ্চিম যাওয়ার মতো পথ পাওয়া গেলে তবে বাণিজ্যের খুব সুবিধা হয়। ১৮৪৯ খৃস্টাব্দে এই রাস্তার খোঁজে তিনি কয়েকজন সে-দেশী লোকের সঙ্গে কালাহারি মরুভূমি পার হয়ে ক্রমাগত উত্তর-পশ্চিম মুখে ঘুরতে ঘুরতে, পাঁচ বছরে পর্তুগীজ রাজ্যে পশ্চিম সমুদ্রের উপকূলে এসে হাজির হলেন। পথের কষ্টে এবং জ্বরে ভুগে তার শরীর তখন একেবারে ভেঙে গেছে, আর যেন নড়বার শক্তি নাই। কিন্তু তিনি সহজে থামবার লোক নন। কয়েক মাস বিশ্রাম করেই তিনি আবার ফিরবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এবার তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন সেখান থেকে একেবারে পূর্বদিকে সমুদ্রের কূল পর্যন্ত না গিয়ে তিনি থামবেন না।

 জলের পথ দিয়ে নানা নদীর বাঁক ধরে ঘুরতে ঘুরতে, তিনি ক্রমে জাম্বেসি নদীতে এসে পড়লেন। তার আগে আর কোনো বিদেশী সে জায়গা দেখে নাই। সেখানকার লোকদের সঙ্গে তিনি আলাপ করে এক আশ্চর্য খবর শুনলেন। তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমাদের দেশেও কি ধোঁয়ায় গর্জন করতে পারে?” লিভিংস্টোন বললেন, “সে কিরকম?” তারা বলল, “তুমি ধোয়া-গর্জনের পাহাড় দেখ নি?” লিভিংস্টোনের ভারি আগ্রহ হল, এ জিনিসটা একবার দেখতে হবে। সেই জাম্বেসি নদী দিয়ে নৌকা করে তিনি অনেক দূর গিয়ে দেখলেন, এক জায়গায় ধোঁয়ার মতো পাঁচটা স্তন্ত উঠেছে, তার চারদিকের দৃশ্য এত সুন্দর যে, লিভিংস্টোনের বোধ হল এমন চমৎকার স্থান তিনি আগে আর কখনো দেখেন নি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, নদীটা গেল কোথায়? সামনে খালি চড় আর পাহাড়। নদীর চিহ্নমাত্র নাই—আর পাহাড়ের ওদিকে খালি ধোয়া আর গর্জন। সেইখানে নৌকা বেঁধে লিভিংস্টোন হেঁটে দেখতে গেলেন ব্যাপারখানা কি? গিয়ে যা দেখলেন তাতে তার বোধ হল যে তার জন্ম সার্থকতার এত বৎসরের পরিশ্রম সার্থক। তিনি দেখলেন, নদীটা একটা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে ঢুকে পাহাড়ের পেট কেটে তিনশো হাত খাড়া ঝরনার মতো ঝরে পড়ছে। এত বড়ো ঝরনা লিভিংস্টোন কোনোদিন চক্ষে দেখেন নি। পড়বার বেগে ঝরনার জল ভয়ানক শব্দে ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে প্রায় দুশো হাত উঁচু হয়ে উঠছে—তার উপর সূর্যের আলো পড়ে চমৎকার রামধনুর

৫৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী।২