পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যেখানে যত গরিবের স্কুল আর হাসপাতাল ছিল, ফুরেন্স তাহার সবগুলির মধ্যেই থাকিতেন। সেই সময়ে ইংলণ্ডে কয়েদীদের অবস্থা বড়ো ভয়ানক ছিল। জেলখানাগুলি অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর এবং তাহাদের বন্দোবস্ত এমন বিশ্রী যে, একবার যে জেলে ঢুকিয়াছে তাহার পক্ষে ভবিষ্যতে আবার ভালো হওয়া একরূপ অসম্ভব। মিসেস ফ্রাই নামে একজন ইংরাজ মহিলা এই কয়েদীদের উন্নতির জন্য নানারূপ চেষ্টা করিতেছিলেন—কিসে তাহারা আবার চাকরি পায়, কিসে তাহারা সমাজের কাছে ভালো ব্যবহার পায়, কিসে তাহাদের মধ্যে আবার সাধুভাব ফিরিয়া আসে, তিনি এই চিন্তাতেই সমস্ত সময় কাটাইতেন। ইহার সঙ্গে ফুরেন্সের আলাপ হওয়ায়, দুজনেরই উৎসাহ খুব বাড়িয়া গেল।

 ফুরেন্স বুঝিলেন যে ইংলণ্ডের হাসপাতালগুলির উন্নতি করিতে হইলে রোগীর সেবার জন্য বিশেষভাবে শিক্ষিত লোক চাই। সেবার কাজ মেয়েদের দ্বারাই খুব ভালোরকম হইবার কথা, সুতরাং তাহার মনে এই চিন্তা আসিল যে, একদল মেয়েকে রোগীর শুশ্রষা বিষয়ে ভালোরকম শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

 সে সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে এ-বিষয়ে কিছু কিছু বন্দোবস্ত ছিল। সেখানে এমন সব শুশ্রষাকারিণীর দল ছিল, যাঁহারা আবশ্যকমতো রোগীর শুশ্রুষ ও যুদ্ধক্ষেত্রে আহতের সেবার জন্য সকল সময়ে প্রস্তুত থাকিতেন। ফ্রান্স দেশে Sisters of mercy নামে একদল সন্ন্যাসিনী বহুকাল হইতে অতি আশ্চর্যরূপে এই কাজ করিয়া আসিতে- ছিলেন। জার্মানিতেও শুশ্রষা-শিক্ষার ভালো বন্দোবস্ত ছিল। মিসেস ফ্রাইয়ের সঙ্গে ফুরেন্স পরামর্শ করিলেন, একবার ঐ-সকল দেশ ঘুরিয়া এই বিষয়ে কিছু শিক্ষা করিয়া আসি। যেমন কথা তেমনি কাজ। ফুরেন্স পরম উৎসাহে বিদেশে গিয়া এই শিক্ষায় লাগিয়া রহিলেন। সেখানে তাঁহার বুদ্ধি উৎসাহ ও সেবার আগ্রহ দেখিয়া, সকলেই অবাক হইয়া গেল। তিনি ছয় মাসের মধ্যে রীতিমত পরীক্ষা পাশ করিয়া এবং সকল বিষয়ে আশ্চর্য সফলতা দেখাইয়া দেশে ফিরিলেন; কিন্তু এত পরিশ্রমের ফলে তাঁহার শরীর এমন ভাঙিয়া পড়িল যে, তাহার কাজ আরম্ভ করিতে আরো বছরখানেক দেরি হইয়া গেল। সুস্থ হইয়াই তিনি চারিদিকে হাসপাতাল আতুরাশ্রম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করিয়া দেশের মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন আনিয়া ফেলিলেন। তখন তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর।

 ইহার কিছুদিন পরেই ১৮৫৪ খৃস্টাব্দে রুশিয়ার সঙ্গে ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের লড়াই বাধিয়া গেল। ইংরাজের সে সময়ে যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত ছিল না। তাড়াতাড়ি কিছু সৈন্য সংগ্রহ করিয়া তাহাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হইল। তাহাদের চিকিৎসার জন্য বা আহতের সেবার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করিবার সময় হইল না। ইহার ফল এই হইল যে, চারিদিকে অসম্ভবরকম বে-বন্দোবস্ত দেখা দিল। এমন-কি, রুগ্ন ও আহত সৈন্যগণ হাসপাতালে গিয়া, ঔষধপথ্য ও চিকিৎসার অভাবে দলে দলে মরিতে লাগিল। সময়ের অবস্থা এমন ভয়ানক হইয়াছিল যে, যুদ্ধে যত লোক মারা পড়ে তাহার সাতগুণ লোকে হাসপাতালে প্রাণ হারায়।

 এই-সকল কথা ইংলণ্ডে পৌছিলে পর লোকে শিহরিয়া উঠিল। “কি করা যায়,

৬২
সুকুমায় সমগ্র রচনাবলী :২