পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাড়িতেই যান লোকে দরজা বন্ধ করে দেয়। শেষটায় হতাশ হয়ে তিনি একটা গাছের তলায় বসে পড়লেন। এইরকম অনেকক্ষণ বসে থাকবার পর, একটি নিগ্রো স্ত্রীলোক আর তার মেয়ে এসে, তাকে ডেকে তাদের বাড়িতে নিয়ে খেতে আর বিশ্রাম করতে দিল। সে-দেশীয় মেয়েরা সন্ধ্যার পর ঘরে বসে চরকায় সুতো কাটে আর গান গায়। মাঙ্গো পার্কের নামে তারা গান বানিয়ে গেয়েছিল—সেই গানটার অর্থ এই-‘ঝড় বইছে আর বৃষ্টি পড়ছে, আর বেচারা সাদা লোকটি শ্রান্তি অবশ হয়ে আমাদের গাছতলায় এসে বসেছে। ওর মা নেই, ওকে দুধ এনে দেবে কে? ওর স্ত্রী নেই, ওকে ময়দা পিষে দেবে কে? আহা, ঐ সাদা লোকটিকে দয়া কর। ওর যে মা নেই, ওর যে কেউ নেই।'

 তিনি অনেকবার ‘মুর’দের হাতে পড়েছিলেন। এক-একটা গ্রামে তিনি যান অরি সেখানকার সর্দার তাকে ডেকে পাঠায়, নাহয় লোক দিয়ে ধরপাকড় করে নিয়ে যায়। এইরকম অবস্থায় তারা তাঁর কাছ থেকে, প্রায়ই কিছু-না-কিছু বকসিস আদায় না করে ছাড়ত না। এমনি করে তাঁর সঙ্গের জিনিসপত্র প্রায় সবই বিলিয়ে দিতে হয়েছিল। একবার এক সর্দার তাঁর ছাতাটি তাঁর কাছ থেকে আদায় করে মহা খুশি। ছাতাটাকে সে ফটফট করে খেলে আর বন্ধ করে; আর হো হো করে হাসে। কিন্তু ওটা দিয়ে কি কাজ হয়, সে কথাটা বুঝতে তার নাকি অনেকখানি সময় লেগেছিল। আসবার সময় মাঙ্গো পার্কের নীল কোট আর তাতে সোনালি বোতাম দেখে সর্দারমশাই কোটটাও চেয়ে বসলেন। তখন সেটা তাকে না দিয়ে অরি উপায় কি? যাহোক, সর্দারের মেজাজ ডালা বলতে হবে, সে ছাতা আর কোটের বদলে তাকে অনেক জিনিসপত্র সঙ্গে দিয়ে, তার চলাফিরার সুবিধা করে দিল। কিন্তু সকল সময়ে তিনি এত সহজে পার পান নি। আলি নামে এক মূর রাজার দল তাকে বন্দী করে, মাসখানেক খুব অত্যাচার করেছিল। প্রথমটা তারা ঠিক করল যে, এই বিধর্মী খৃস্টানটাকে মেরে ফেলাই ভালো। তার পর কি যেন ভেবে তারা আবার বলল, “ওর ঐ বেড়ালের মতো চোখ দুটো গেলে দেও।” যাহোক শেষটায় সেখানকার রানীর অনুগ্রহে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।

 এমনি করে অত্যাচার অপমান চুরি ডাকাতি সব সহ্য করে, মাঙ্গো পার্ক শেষটায় একেবারে ফকির হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর লোকজন কাপড়চোপড় জিনিসপত্র, এমন-কি, ঘোড়াটি পর্যন্ত সঙ্গে রইল না। কিন্তু এত কষ্ট সয়েও শেষটায় যখন তিনি নাইগার নদীর সন্ধান পেলেন, তখন তার মনে হল এত কষ্ট এত পরিশ্রম সব সার্থক হয়েছে। এমনি করে তিনি দুই বৎসর সে দেশ ঘুরে, তার পর দেশে ফিরে আসেন। এই দুই বৎসরের সব ঘটনা তিনি প্রতিদিন লিখে রাখতেন। আমরা এখানে যা লিখছি তার প্রায় সবই তাঁর সেই ডায়ারি থেকে নেওয়া।

 আফ্রিকার নিগ্রো জাতীয় লোকদের আমরা সাধারণত ‘অসভ্য জাতি’ বলে থাকি। কিন্তু মালো পার্ক বলেন যে, মুর বা আরব জাতীয় লোকেদের মধ্যে যারা কতকটা সভ্য হয়েছে, তাদের চাইতে এই অসভ্যো অনেক ভালো। আমাদের দেশে যেমন সঁওতালরা গ্রায়ই খুব সরল অরি সত্যবাদী হয়, মোটের উপর এরাও তেমনি। তাদের দেশে তারা বিদেশী তোক দেখে নি, কাজেই হঠাৎ অদ্ভুত পোশাক পরা হলদে চুল, নীল চোখ সাদা

জীবনী
৬৫

সু, স, র-২-৮