পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 দুরবীনে আকাশ দেখিয়া তাহার মনে কী যে আনন্দ হইল, সে আর বলা যায় না। তিনি যেদিকে দুরবীন ফিরান, যাহা কিছু দেখিতে যান সবই আশ্চর্য দেখেন। চাঁদের উপর দুরবীন কষিয়া দেখা গেল, তার সর্বাঙ্গে ফোস্কা। কোন জন্মের সব আগ্নেয় পাহাড় তার সারাটি গায়ে যেন চাক বাঁধিয়া আছে। বৃহস্পতিকে দেখা গেল একটা চ্যাপটা গোলার মতো তার আবার চার চারটি চাঁদ। সূর্যের গায়ে কালো কালো দাগ। ছায়া-পথের ঝাপসা আলোয় যেন হাজার হাজার তারার গুড়া ছড়াইয়া আছে। শুক্রগ্রহ যে ঠিক আমাদের চাদের মতো বাড়ে কমে, দুরবীনে তাহাও ধরা পড়িল। এমনি করিয়া গ্যালিলিও কত যে আশ্চর্য ব্যাপার দেখিতে লাগিলেন তাহার আর শেষ নাই। অবশ্য এ-সব কথাও লোকে বিশ্বাস করিতে চাহিল না—কোনো কোনো পণ্ডিত গ্যালিলিওর সঙ্গে তর্ক করিতে আসিয়া, তাঁহার দুরবীন দেখিয়া তবে সব বিশ্বাস করিলেন। কেহ সব দেখিয়াও বলিলেন, “ও-সব কেবল দেখার ভুল চোখে ধাধা লাগিয়া ঐরূপ দেখায়—আসলে আকাশে এরকম কিছু নাই।” একজন পণ্ডিত দুরবীন দিয়া বৃহস্পতির চাদ দেখতে সাফ অস্বীকার করিলেন।

 কমে কথাটা গুরুতর হইয়া উঠিল। লোকে বলিতে লাগিল, গ্যালিলিও এইরকম- ভাবে যা-তা প্রচার করিতে থাকিলে চেকের ধর্মবিশ্বাস আর টিকিবে না। পৃথিবী স্থির হইয়া আছে, এ কথাই যদি লোকে বিশ্বাস না করে, তবে কিসে তাহারা বিশ্বাস করিবে? স্বয়ং ধর্মগুরু পোপ আদেশ দিলেন, “তুমি এই-সকল জিনিস লইয়া বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিও না। তোমার যা বিশ্বাস, তা তোমারই থাক। তাহা লইয়া যদি লোকের মনে নানারকম সন্দেহ জন্মাইতে যাও, তবে ভালো হইবে না।” গ্যালিলিও বুঝিলেন যে ‘ভালো হইবে না' কথাটার অর্থ বড়ো সহজ নয়। নিজের প্রাণটি বাঁচাইতে হইলে আর গোলমাল না করাই ভালো। কয়েক বৎসর গ্যালিলিও চুপ করিয়া রহিলেন —অর্থাৎ ঐ বিষয়ে চুপ করিয়া রহিলেন। কিন্তু তাহার মনের রাগ ও ক্ষোভ গেল। কিছুদিন জোয়ার ভাটা ধমকেতু ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা করিয়া, তিনি আবার সেই পৃথিবী ঘোরার কথা লইয়া নাড়াচাড়া আরম্ভ করিলেন। কিন্তু এবারে ‘পৃথিবী ঘোরে’ এ কথা স্পষ্টভাবে না বলিয়া, তিনি তাঁহার বিরুদ্ধদলকে নানারকমে ঠাট্টা বিদ্রুপ করিয়া সকলকে ক্ষ্যাপাইয়া তুলিলেন। তখন পাদরির দল তাহার বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ আনিল যে, গালিলিও ধর্মগুরু পোপকে অপমান করিয়াছেন। অভিযোগটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, কিন্তু পাদরিদের ধর্মবিচার-সভায় গ্যালিলিওর উপর তাহার সমস্ত কথা ফিরাইয়া লইবার হুকুম হইল—না লইলে প্রাণদণ্ড। গ্যালিলিওর বয়স তখন প্রায় সত্তর বৎসর। অনেক অত্যচারের পর তিনি তাহার কথা ফিরাইয়া লইলেন। সভায় সকলের সম্মুখে বলিলেন, “আমি যাহা শিক্ষা দিয়াছি, তাহা ভুল বলিয়া স্বীকার করিলাম।” কিন্তু মুখে এ কথা বলিলেও তাঁহার মন অহা মানিল না—তিনি পাশের একটি বন্ধুকে দৃঢ়তার সহিত বলিলেন, “অস্বীকার করিলে হইবে কি? এই পৃথিবী এখনো চলিতেছে।”

 এইরূপে নিজের জীবনের উপার্জিত সমস্ত কে অস্বীকার করিয়া, তিনি মনের ক্ষোভে ভগ্নদেহে বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। তার পর যে কয়েক বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন,

জীবনী
৬৯